Why we want our voice to be heard?

Pages

Saturday, April 23, 2011

জাতিসংঘের প্রতিবেদন: চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় পার্বত্য সংকট ঘনীভূত

জাতিসংঘের প্রতিবেদন

চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় পার্বত্য সংকট ঘনীভূত


অরুণ কর্মকার | তারিখ: ২৩-০৪-২০১১

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় এখন সেখানে চুক্তির আগের সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। চুক্তিপূর্ব সময়ের মতোই ওই অঞ্চলের রাজনৈতিক পরিস্থিতিও অস্থিতিশীল। আদিবাসী পাহাড়ি ও পুনর্বাসিত বাঙালিদের মধ্যে হাঙ্গামা চলছে আগের মতোই।
জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিলের আদিবাসীবিষয়ক স্থায়ী ফোরামের (পার্মানেন্ট ফোরাম অন ইনডিজিনাস ইস্যুস) এক প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে আগামী ১৬ থেকে ২৭ মে অনুষ্ঠেয় ওই ফোরামের দশম অধিবেশনে উপস্থাপনের জন্য প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়ন-পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে ওই অঞ্চলে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে সরকার, দাতাগোষ্ঠী, আন্তর্জাতিক এনজিও এবং জাতিসংঘের করণীয় সম্পর্কে কিছু সুপারিশ করা হয়েছে।
এর মধ্যে জাতিসংঘের অন্যতম করণীয় হিসেবে সুপারিশ করা হয়েছে, শান্তিরক্ষা মিশনে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালনকারী বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিজ দেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে কী ভূমিকা পালন করছে, তা জাতিসংঘ সচিবালয়ের শান্তিরক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা বিভাগের তদারক করা উচিত।
প্রতিবেদন তৈরির জন্য আদিবাসীবিষয়ক স্থায়ী ফোরামের সদস্য লারস এন্ডারস বায়েরকে বিশেষ দায়িত্ব (স্পেশাল র‌্যাপোর্টিয়ার) দিয়ে বাংলাদেশে পাঠানো হয়। গত বছরের সেপ্টেম্বরে তিনি এ দেশে এসে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদারসহ সরকার এবং বেসরকারি পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। গত ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি ১৯ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনটি চূড়ান্ত করেন।
চুক্তি বাস্তবায়ন-পরিস্থিতি: প্রতিবেদনে পার্বত্য চট্টগ্রামের পূর্বাপর ইতিবৃত্ত বর্ণনা করে বলা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ওই অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদি এক গেরিলা যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে শান্তি স্থাপনের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল। কিন্তু ওই চুক্তি স্বাক্ষরের ১৩ বছর পর আজ একটি বিষয় স্পষ্ট যে চুক্তির মৌলিক ও প্রধান অনুচ্ছেদগুলো বাস্তবায়ন করা হয়নি।
এর উদাহরণ হিসেবে বলা হয়, চুক্তি অনুযায়ী সেখানকার আঞ্চলিক ও স্থানীয় শাসনব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠ আদিবাসী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়নি। সেখানকার ঐতিহ্যগত শাসনব্যবস্থা (রাজা, হেডম্যান, কার্বারি) কার্যত অকার্যকর করে রাখা হয়েছে। ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি, শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন ফেলে রাখা হয়েছে।
ফলে এখন অবস্থা এমন যে সরকার চুক্তি বাস্তবায়নের কথা বললেও কেউই তা বিশ্বাস করে না। এ নিয়ে মানুষের হতাশা বাড়ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান সংঘাতময় পরিস্থিতি সম্পর্কে চাকমা সার্কেলের প্রধান রাজা দেবাশীষ রায় প্রথম আলোকে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে আদিবাসীরা সাধারণ প্রশাসনের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলছেন। কোনো সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশ নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করবে, এই বিশ্বাস তাঁরা আর রাখতে পারছেন না। এ অবস্থায় সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘মিশ্র পুলিশ বাহিনী’ কাজে লাগাতে পারে। এই বাহিনীতে বাঙালিদের পাশাপাশি চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা প্রভৃতি আদিবাসীদেরও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
প্রতিবন্ধকতা: প্রতিবেদনে বলা হয়, অঞ্চলটি এখনো সেনাবাহিনী অধ্যুষিত। যদিও ১৯৯০ সালে অস্ত্রবিরতির পর থেকে সেখানে সশস্ত্র অনুপ্রবেশের (ইনসার্জেন্সি) কোনো ঘটনা ঘটেনি বা অভিযোগ পাওয়া যায়নি, তবু সেখানে ‘অপারেশন উত্তরণ’ নামে সেনাবাহিনীর ‘কাউন্টার ইনসার্জেন্সি’ তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। তারা সাধারণ বেসামরিক বিষয়াদিতেও হস্তক্ষেপ করে বলে অভিযোগ রয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে কত সেনাসদস্য অবস্থান করছেন, তা সঠিকভাবে বলা যায় না। তবে দেশের প্রায় এক-দশমাংশ এলাকাজুড়ে বিস্তৃত ওই অঞ্চলে দেশের সেনাবাহিনীর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মোতায়েন রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, যুদ্ধাবস্থা ছাড়া এটা কোনোভাবেই যৌক্তিক হতে পারে না।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশটির প্রধান বিরোধী দল বিএনপি শুরু থেকেই পার্বত্য চুক্তির বিরোধিতা করে আসছে। তারা বিষয়টিকে ব্যবহার করে দেশের অন্যান্য এলাকা থেকে নির্বাচনী ফায়দা লুটতেও দ্বিধা করে না। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগও চুক্তি বাস্তবায়নে দ্বিধাগ্রস্ত। পাশাপাশি মারাত্মক কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থার এই দেশে আমলাতন্ত্র দারুণ প্রভাবশালী। সরকারের যেকোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে আমলাদের সব সময়ই বিশেষ ভূমিকা থাকে।
মানবাধিকার: পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকারের বিষয়টি খুব নাজুক। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রধান শিকার আদিবাসী পাহাড়িরা। এসবের মধ্যে রয়েছে কথায় কথায় গ্রেপ্তার, নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, মানবাধিকার কর্মীদের হেনস্থা করা, যৌন নিপীড়ন প্রভৃতি।
এসব ঘটনা থেকে অনেক বড় দুর্ঘটনা ঘটে, যেমন ঘটেছিল বাঘাইহাটে, ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। আর ওই ধরনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সংঘটিত হয় পাহাড়ি-বাঙালি দাঙ্গা। এর পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রামে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও সংঘাত-সংঘর্ষ বেড়ে চলেছে। চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় এ ধরনের সংঘাতের প্রেক্ষিত সৃষ্টি হয়েছে।
করণীয় কী: এই সামগ্রিক অবস্থায় পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতির উন্নয়নে করণীয় বিষয়ে প্রতিবেদনে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। সরকারের জন্য করণীয় হিসেবে বলা হয়েছে, সরকার তার বাকি শাসনমেয়াদে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একটি সময়সূচিভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করবে। এতে চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটিসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কমিটি, কার্যালয় ও কর্মকর্তা কখন কোন কাজটি শেষ করবেন, তা উল্লেখ থাকবে। অবিলম্বে ভূমি কমিশন আইন সংশোধন করে চুক্তি অনুযায়ী ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তির কাজ ত্বরান্বিত করবে এবং চুক্তি অনুযায়ী সেনাবাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্পগুলো পর্যায়ক্রমে গুটিয়ে নিতে হবে।
সরকারকে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, জেলা পরিষদ ও অন্যান্য সরকারি বিভাগের হাতে চুক্তি অনুযায়ী দায়িত্ব হস্তান্তর করতে হবে। যেসব কাজে সামরিক বিষয়াদি জড়িত নয়, সে কাজ সাধারণ ও বেসামরিক প্রশাসনের হাতে ছেড়ে দিতে হবে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ও অভিযোগগুলো আমলে নিয়ে আইনের আওতায় যথাযথ বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকারদের জন্য আইন সহায়তা কেন্দ্র স্থাপন ও কার্যকর করতে হবে। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার গ্রুপ ও গণমাধ্যমকে নির্বিঘ্নে ওই অঞ্চল এবং কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে তা পরিদর্শনের সুযোগ দিতে হবে। আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে। জাতিসংঘের যেসব কনভেনশনে বাংলাদেশ সই করেছে, সেগুলো যথাযথভাবে মেনে চলতে হবে।
সুপারিশে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন ওই অঞ্চলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ও অভিযোগ তদন্ত করবে, তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করবে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা রোধে সুপারিশ করবে। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার, দাতাগোষ্ঠী, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো ওই অঞ্চলের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে প্রতিবেদন তৈরি করবে।
জাতিসংঘের করণীয় হিসেবে সুপারিশে বলা হয়, শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। সেই সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি স্থাপন ও মানবাধিকার সংরক্ষণে কী ভূমিকা রাখছে, তা জাতিসংঘ সচিবালয়ের শান্তিরক্ষী কার্যক্রম পরিচালনা বিভাগ (ডিপার্টমেন্ট অব পিস কিপিং অপারেশনস অব দ্য সেক্রেটারিয়েট) তদারক করবে। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিলের আদিবাসীবিষয়ক স্থায়ী ফোরামের উদ্দেশে প্রতিবেদনে বলা হয়, ফোরামের উচিত পার্বত্য চট্টগ্রামে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভূমিকা ও কার্যক্রম খতিয়ে দেখতে জাতিসংঘ সচিবালয়ের শান্তিরক্ষী কার্যক্রম পরিচালনা বিভাগকে বলা।
সুপারিশে বলা হয়েছে, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জীবিকার উন্নয়নে কর্মসূচি পরিচালনা করবে। ইউনিসেফ শিশুদের সার্বিক উন্নয়নে কাজ করবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি সম্পর্কে আরও বিস্তারিত ও গভীরতর সমীক্ষা চালাতে হবে। দাতা সংস্থাগুলো তাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়ন ও আদিবাসীদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় অব্যাহতভাবে কাজ করবে।
বিশেষজ্ঞ অভিমত: পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে গবেষক ও তথ্য কমিশনের সদস্য অধ্যাপক সাদেকা হালিম প্রতিবেদনের সুপারিশ সম্পর্কে বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে সাধারণভাবে আমরা যেসব বিষয় জানি এবং বলি, জাতিসংঘের প্রতিবেদনটিতেও তা-ই বলা হয়েছে। এ ছাড়া সেনাবাহিনীর ভূমিকা পর্যবেক্ষণের ব্যাপারে যে কথা বলা হয়েছে, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিদেশে শান্তিরক্ষী মিশনে গিয়ে আমাদের যে সেনাবাহিনী প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখছে, নিজেদের দেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের আচরণে আমরা ক্ষুব্ধ না হয়ে পারি না। পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর আচরণগত বিষয়ের দিকে বিশেষভাবে খেয়াল রাখা উচিত।’
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে আরেকজন গবেষক অধ্যাপক আমেনা মোহসীন বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর ভূমিকা তদারকির যে সুপারিশ করা হয়েছে, সেটি একটি ভালো সুপারিশ। এটার দরকার আছে। তবে জাতিসংঘ সচিবালয়ে বসে কারা এটা তদারক করবে, সেটা দেখতে হবে। সেই তদারকি যেন নিরপেক্ষ হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। আর এতে বাংলাদেশের সুশীল সমাজের প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে। তিনি বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ার যেসব দেশ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে কাজ করছে তার মধ্যে ভারত ও শ্রীলঙ্কা তাদের সেনাবাহিনী ও পুলিশের জন্য মিশনে যাওয়ার আগে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। আমাদের দেশেও এটা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’

.....................................................................................
Source: Prothom-alo

1 comment: