Pages

Saturday, December 4, 2010

শান্তিচুক্তির ১৩ বছর অবহেলায় অনিশ্চিত পাহাড়ের ভবিষ্যৎ

শান্তিচুক্তির ১৩ বছরঅবহেলায় অনিশ্চিত পাহাড়ের ভবিষ্যৎবিপ্লব রহমান
পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের ১৩ বছরেও চুক্তির অন্তত আটটি মৌলিক শর্ত এখনো বাস্তবায়ন না হওয়ায় দীর্ঘ অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে পাহাড়ের ভবিষ্যৎ। পাহাড়ি নেতারা বলছেন, গত ১৩ বছরে পার্বত্য সমস্যা সমাধানে তথা শান্তিচুক্তির মৌলিক শর্তগুলো বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় সরকারই চরম অবহেলা দেখিয়ে আসছে। এতে পার্বত্য সমস্যা হচ্ছে জটিল থেকে জটিলতর। চুক্তি বাস্তবায়নের গুরুভার সরকারকেই বহন করতে হবে। অন্যদিকে সরকারপক্ষ বলছে, এ সরকার শান্তিচুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়নে আন্তরিক। এ জন্য চুক্তিসংশ্লিষ্ট সব মহলের সমঝোতা প্রয়োজন। সাংঘর্ষিক অবস্থায় চুক্তি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে। শান্তিচুক্তির ফলে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সাবেক গেরিলা গ্রুপ শান্তিবাহিনীর প্রায় দুই দশকের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংঘাত বন্ধ হয়। পাহাড়ে তৈরি হয় উন্নয়ন ও স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় আশাবাদ। কিন্তু দৃশ্যত শান্তিচুক্তির মূল বিষয়গুলো বাস্তবায়ন না হওয়ায় এ আশাবাদ এখন অনেকটাই হতাশায় পরিণত হয়েছে। চুক্তির ১৩তম বর্ষপূর্তিতে আজ বৃহস্পতিবার ঢাকায় ও পাহাড়ে শোভাযাত্রা, মানববন্ধন আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ নানা কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।
শান্তিচুক্তি বিশ্লেষণ করে ও খোঁজ-খবর নিয়ে জানা গেছে, চুক্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামকে আদিবাসী পাহাড়ি অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে স্বীকার করে নেওয়া হলেও এ পর্যন্ত পার্বত্যাঞ্চলের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও স্বকীয়তা বজায় রাখতে কোনো সরকারই কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। ফলে প্রতিনিয়তই পাহাড়ি-বাঙালি জনসংখ্যার ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।
জমির বিরোধকে কেন্দ্র করে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘাতও বাড়ছে।
চুক্তি অনুযায়ী পাহাড়ের সাধারণ প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলার সমন্বয় ও তত্ত্বাবধান, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, পুলিশ (স্থানীয়), বন ও পরিবেশ, মাধ্যমিক শিক্ষা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সহ তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তরের কথা থাকলেও এখনো এ কাজ করা হয়নি। অন্যদিকে চুক্তি মেনে পাহাড়ের স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে করা পৃথক ভোটার তালিকায় নির্বাচনের উদ্যোগ না নেওয়ায় ২১ বছর ধরে পরিষদগুলো অকার্যকর করে রাখা হয়েছে। এই দীর্ঘ সময় ধরে পরিষদগুলোতে শুধু দলীয় লোকজনই নিয়োগ পাচ্ছেন।
আঞ্চলিক পরিষদ আইন, ১৯৯৮ এখনো কার্যকর করার উদ্যোগ নেই। এখনো এ পরিষদের কার্যবিধিমালা, সংস্থা চেয়ারম্যান ও সদস্যদের সুযোগ-সুবিধাসংক্রান্ত প্রবিধানমালা প্রণয়ন, জমি অধিগ্রহণ, অর্থ বরাদ্দ ও জনবল নিয়োগ ইত্যাদি বিষয় বাস্তবায়ন করা হয়নি। তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ, পৌরসভা, উন্নয়ন বোর্ড এবং জেলা ও থানার কার্যক্রমের সঙ্গে আঞ্চলিক পরিষদের কাজের সমন্বয় নেই।
চুক্তিতে পাহাড় থেকে নিরাপত্তা বাহিনীর সব অস্থায়ী ছাউনি প্রত্যাহার করার কথা থাকলেও প্রায় ৫০০ অস্থায়ী ছাউনির মধ্যে এ পর্যন্ত মাত্র ৬৬টি ছাউনি প্রত্যাহার করা হয়েছে। অন্যদিকে পাহাড়ে এখনো নিরাপত্তা বাহিনীর 'অপারেশন উত্তরণ' বহাল রয়েছে বলে অভিযোগ আছে।
পাহাড়ের জায়গা-জমির বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন, ২০০১-এর ধারাগুলো গত ৯ বছরেও সংশোধন করা হয়নি। উপরন্তু ভূমি কমিশন জমির বিরোধ না মিটিয়ে চুক্তি উপেক্ষা করে ভূমি জরিপের উদ্যোগ নিয়ে অহেতুক বিতর্কে জড়ানো হয়েছে।
পাহাড়ের অস্থানীয় লোকজনের কাছে দেওয়া প্রায় দুই হাজার প্লটের ৫০ হাজার একর ভূমির ইজারার মধ্যে এ সরকারের আমলে মাত্র ৫৯৩টি প্লট বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এখনো কোনো ইজারাদারই ভূমি দখলীস্বত্ব ছেড়ে দেননি। অন্যদিকে অধিকাংশ ইজারাদার তাঁদের ইজারা পুনর্বহালের জন্য আবেদন করেছেন বলে জানা গেছে।
প্রত্যাগত শরণার্থীকল্যাণ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৬-৯৭ সালে ২০ দফা প্যাকেজ প্রতিশ্রুতির আওতায় ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে প্রত্যাগত ১২ হাজার ২২২ পাহাড়ি শরণার্থী পরিবারের মধ্যে এখনো ৯ হাজার ৭৮০ পরিবার তাদের জায়গা-জমি ফেরত পায়নি। এ ক্ষেত্রে সরকারগুলো কোনো পদক্ষেপই নেয়নি। এ ছাড়া গত ১৩ বছরে শরণার্থীবিষয়ক টাস্কফোর্স বারবার গঠন ও পুনর্গঠিত হয়েছে। কিন্তু এ পর্যন্ত কোনো টাস্কফোর্সই ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী পুনর্বাসনের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ পাহাড়ি উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয়নি। এমনকি পাহাড়ের অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের তালিকাই হয়নি।
শান্তিচুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে একজন আদিবাসী পাহাড়ি পূর্ণ মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পাবেন। কিন্তু গত বিএনপি ও বর্তমান মহাজোট সরকারের আমলে চুক্তি উপেক্ষা করে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে পাহাড়ি প্রতিমন্ত্রী। গত ১৩ বছরে চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির সভাও নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয়নি। এ সরকারের আমলে গত দুই বছরে কমিটির মাত্র দুটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শান্তিচুক্তিতে উল্লেখ করা মৌলিক শর্তগুলো বাস্তবায়নে এখনো কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান ও জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমা কালের কণ্ঠকে বলেন, সরকারগুলোর সদিচ্ছার অভাবে চুক্তিটি যথাযথভাবে কার্যকর হতে পারছে না। চুক্তির মৌলিক শর্তগুলো বাস্তবায়নের প্রশ্নে সব সরকার কালক্ষেপণ করে চলেছে।
সাবেক গেরিলা নেতা সন্তু লারমা বলেন, শান্তিচুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্বিক পরিস্থিতির মৌলিক কোনো অগ্রগতি হয়নি। পাহাড়ের সর্বক্ষেত্রে এখনো সেনা কর্তৃত্ব বজায় রয়েছে। জুম্ম (পাহাড়ি) জনগণের ওপর রাষ্ট্রযন্ত্রের দমন-পীড়ন এখনো অব্যাহত।
সন্তু লারমা চুক্তি বাস্তবায়নে অবিলম্বে রোডম্যাপ ঘোষণা, পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন জেলা পরিষদ আইন কার্যকর করা, চুক্তি অনুসারে আইন সংশোধন করে ভূমি কমিশন সক্রিয় করা, পাহাড় থেকে সব অস্থায়ী নিরাপত্তা ছাউনি প্রত্যাহার, পাহাড়ি শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পুনর্বাসন, আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া, সন্ত্রাসের দায়ে ইউপিডিএফকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করাসহ বিভিন্ন দাবি জানান।





চাকমা রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় বলেন, জনসংহতি সমিতির সঙ্গে সরকারের শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও চুক্তি বাস্তবায়নের গুরুভার সরকারকেই বহন করতে হবে। রাঙামাটিতে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, 'কিছুদিন আগে পাহাড়ের সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী পর্যায়ের প্রতিনিধিরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। এতে প্রধানমন্ত্রী চুক্তি বাস্তবায়নে যে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার আশা দিয়েছেন, তাতে আমি আশান্বিত।' শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করার পাশাপাশি কিছুদিন পর পর এর অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করার দাবি জানান তিনি।
পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার বলেন, শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের জন্য এ চুক্তি স্বাক্ষরকারী অন্য পক্ষের ইতিবাচক ও সমঝোতামূলক মনোভাব দরকার। সাংঘর্ষিক অবস্থায় চুক্তি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। রাঙামাটিতে সাংবাদিকদের তিনি আরো বলেন, চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন সমঝোতামূলক, ইতিবাচক ও স্থিতিশীল পরিস্থিতি। এ পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য চুক্তির সপক্ষের সব শক্তিকে মতৈক্যে এসে কাজ করতে হবে।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের কাজের মধ্য দিয়েই পার্বত্য সমস্যার সমাধান করা প্রয়োজন। কিন্তু চুক্তি বাস্তবায়নের যাবতীয় প্রস্তুতি যখন সম্পন্ন, তখনই ভূমি কমিশনের কার্যক্রম নিয়ে বিতর্ক করা হয়েছে। তিনি বলেন, শিগগির ভূমি কমিশনের আইন সংশোধন করা হবে।

-------------------------------------
courtesy: kaler kantho.

No comments:

Post a Comment