আদিবাসী
বাঙালি-আদিবাসী জাতীয়তাবাদ বিতর্ক
মানবেন্দ্র লারমা: আমরা করুণার পাত্র হিসেবে আসিনি। আমরা এসেছি মানুষ হিসেবে। তাই মানুষ হিসেবে বাঁচার অধিকার আমাদের আছে।
মিসেস সাজেদা চৌধুরী: বৈধতার প্রশ্ন, জনাব স্পিকার, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা বলতে চেয়েছেন যে এই সংবিধানে তাঁদের উপজাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। আমি বলব, তাঁরাও আজকে স্বাধীন। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির সঙ্গে তাঁদেরও একটা জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
একটি উপজাতি হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার চেয়ে একটি জাতি হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া কি অধিক মর্যাদাজনক নয়?
মানবেন্দ্র লারমা: আমি একজন মানুষ, যেখানে জন্মগ্রহণ করেছি, যে জন্মভূমিতে আজন্ম লালিত-পালিত হয়েছি, সেই জন্মভূমির জন্য আমার যে কথা বলার রয়েছে, সে কথা যদি প্রকাশ করতে না পারি, যদি এই সংবিধানে তার কোনো ব্যবস্থাই দেখতে না পাই, তাহলে আমাকে বলতে হবে যে বঞ্চিত মানুষের জন্য সংবিধানে কিছুই রাখা হয়নি।
আবদুর রাজ্জাক ভূঁইয়া: মাননীয় স্পিকার, আমি প্রস্তাব করছি যে সংবিধান বিলের ৬ অনুচ্ছেদের পরিবর্তে নিম্নোক্ত অনুচ্ছেদটি সন্নিবেশ করা হোক।
‘বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হইবে, বাংলাদেশের নাগরিকরা বাঙালি বলিয়া পরিচিত হইবেন।’
মানবেন্দ্র লারমা: আবদুর রাজ্জাক ভূঁইয়ার প্রস্তাবে আমার একটু আপত্তি আছে। বাংলাদেশের কোটি কোটি জনগণের সঙ্গে আমরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কিন্তু আমি একজন চাকমা। আমার বাপ, দাদা চৌদ্দ পুরুষ—কেউ বলে নাই, আমি বাঙালি। আমি জানি না, এই সংবিধানে আমাদের কেন বাঙালি বলে পরিচিত করতে চায়।
স্পিকার: আপনি কি বাঙালি হতে চান না?
মানবেন্দ্র লারমা: মাননীয় স্পিকার, আমাদিগকে বাঙালি জাতি বলে কখনো বলা হয় না। আমরা কোনো দিনই নিজেদের বাঙালি মনে করি না। আজ যদি এই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সংবিধানের জন্য এই সংশোধনী পাস হয়ে যায়, তাহলে আমাদের এই চাকমা জাতির অস্তিত্ব লোপ পেয়ে যাবে। আমরা বাংলাদেশের নাগরিক। আমরা আমাদের বাংলাদেশি বলে মনে করি এবং বিশ্বাস করি। কিন্তু বাঙালি বলে নয়।
আবদুল লতিফ সিদ্দিকী: মাননীয় স্পিকার, মাননীয় সদস্য আমাদের জাতীয়তাবাদের মূল ভিত্তির প্রতি, আমাদের জাতীয় সার্বভৌমত্বের প্রতি অবৈধ ভাষায় বক্তৃতা করেন।... ৩০ লাখ শহীদের আত্মাহুতির বদলে যে জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা হয়েছে, তারই প্রতি ষড়যন্ত্রমূলক এ বক্তব্য।
এগুলো নাটকের সংলাপ নয়। ১৯৭২ সালের ২৫ ও ৩১ অক্টোবর বাংলাদেশ গণপরিষদে খসড়া সংবিধানের ওপর সদস্যদের আলোচনা ও বিতর্কের একটি অংশ এখানে উদ্ধৃত করা হলো (সূত্র: জুম পাহাড়ের জীবন গণউন্নয়ন গ্রন্থাগার, ঢাকা)।
খসড়া সংবিধানে আবদুর রাজ্জাক ভূঁইয়ার সংশোধনীটি ২৫ অক্টোবরেই পাস হয়ে যায়। চূড়ান্ত সংবিধান গণপরিষদে উত্থাপিত হয় ৪ নভেম্বর। আমরা সবাই আনুষ্ঠানিকভাবে হয়ে যাই বাঙালি। সেই থেকে সমস্যার শুরু। সম্প্রতি জাতীয় সংসদে পাস হয়ে যাওয়া পঞ্চদশ সংশোধনী এই বিতর্ককে আবার উসকে দিয়েছে। ৪০ বছরে অবস্থানের এবং দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়নি কোনো পক্ষের।
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে যারা ‘ইনডিজিনাস পিপল’ হিসেবে মোটামুটি স্বীকৃত, তাদের বাংলায় ভাষান্তর করা হয়েছে ‘আদিবাসী’ নামে। এই শব্দটি নিয়ে চলছে শব্দযুদ্ধ। ‘আদিবাসী’ শব্দটিকে আদিবাসিন্দা হিসেবে বোঝার কারণে বিপত্তি ঘটেছে। বিষয়টি এখানে কে কবে থেকে বাস করছেন, সেটা নয়। বাঙালিও এ দেশে হাজার হাজার বছর ধরে বসবাস করছে। বাঙালি যদি নিজেদের আদিবাসী হিসেবে পরিচয় দিতে চায়, তাহলে অন্য নৃ-গোষ্ঠীর সদস্যদের তাতে আপত্তি থাকার কথা নয়; যেমন অন্যদের বেলায় বাঙালিরও আপত্তি থাকা অনুচিত। আর এক অর্থে কেউই আদিবাসিন্দা নয়। অনেক অনেক বছর আগে এ দেশের একটা বিশাল অংশ ছিল সাগর। তারপর এখানে বদ্বীপ জেগে উঠেছে, অন্য জায়গা থেকে মানুষ এসে বসতি গড়েছে। বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠীর সংমিশ্রণ হয়েছে। তাই কোনো বাঙালির নাক বোঁচা, কারও বা খাড়া; কেউ লম্বা, কেউ বেঁটে, কেউ ফরসা, কেউ তামাটে, কেউবা ঘোর কৃষ্ণবর্ণের; কারও চুল শজারুর কাঁটার মতো, কারও বা কোঁকড়ানো। তার পরেও সবার মধ্যে আমরা মিল খোঁজার চেষ্টা করি; ভাষার, ধর্মের কিংবা অঞ্চলের। নদীতে জেগে ওঠা এক টুকরো জমি নিয়ে যখন দুই জেলা বা দুই গ্রামের মানুষ একে অপরের বুকে বল্লম ঢুকিয়ে দেয়, তখন জাতীয়তাবাদ গ্রাম কিংবা জেলায় অবতরণ করে। আবার যখন একজন বাঙালি ইউরোপের কোনো শহরে কোনো এক সাহেবের ঠ্যাঙানির শিকার হয়, তখন একজন তামিল কিংবা বালুচ তার সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে বলে, আমরা সবাই দক্ষিণ এশীয়। আইডেন্টিটি পলিটিকস আমরা নিজেরাই নির্মাণ করি আমাদের সুবিধা অনুযায়ী। এখানে সামাজিক সম্পর্ক, আবেগ, ঘৃণা এবং নিজেকে গোষ্ঠীগতভাবে প্রকাশ করাটা অনেকাংশে স্থান-কালভেদে নির্ধারিত হয়।
১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত আমাদের ‘মুসলমান’ পরিচয়কে মুখ্য হিসেবে দেখানোর প্রয়াস পেয়েছিল পাকিস্তানি এস্টাবলিশমেন্ট। আমরা ‘বাঙালি’ পরিচয়কে সামনে নিয়ে এসেছিলাম। আমাদের যুক্তি ছিল, বাঙালি হয়েও মুসলমান থাকা যায়। বিপক্ষে যুক্তি ছিল, ওটা বেদাত। ফলে পাকিস্তান ভেঙে গেল। জোরজবরদস্তি না থাকলে ইতিহাস অন্য রকম হতো।
১৯৪৭ সালে মেজরিটি শভিনজমের কারণে ভারত ভেঙে গিয়েছিল। পৃথিবীর অনেক দেশেই এ রকম ঘটছে। সাম্প্রতিকতম দৃষ্টান্ত হলো দক্ষিণ সুদান। আমার দৃঢ়বিশ্বাস, মিলিটারি না থাকলে অনেক দেশ ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। তার পরেও আমরা জাতীয়তাবাদ, জাতি-রাষ্ট্র এসব ধারণা ও তত্ত্ব মনোজগতে অবিরাম তৈরি করে চলেছি।
‘আদিবাসী’ বিতর্কে ফিরে আসা যাক। মানুষ নিজেকে কীভাবে পরিচয় দিতে চায় এবং এটা কে নির্ধারণ করবে? বাঙালি তার মুখ্য পরিচয়ের প্রশ্নে পাকিস্তানের চাপিয়ে দেওয়া আইডেন্টিটি মেনে নেয়নি। এখন যদি সংখ্যাধিক্যের জোরে বাঙালি অন্যের ওপর এ রকম কিছু একটা চাপিয়ে দেয়, সেটা হবে দ্বিচারিতা। অন্যদিকে, সব সময় সমাধানের জন্য জাতিসংঘের দলিল উদ্ধৃত করাও ঠিক নয়। জাতিসংঘ নিজেও ধোয়া তুলসীপাতা নয়। জাতিসংঘের অনুমোদন নিয়েই কোরিয়া দ্বিখণ্ডিত হয়েছে, আফগানিস্তানে আগ্রাসন চলেছে। গণতন্ত্রের নামে লিবিয়ায় আক্রমণ চলছে, কিন্তু মিয়ানমারে নয়। জাতিসংঘে যদি সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেটো না দিত, তাহলে বাংলাদেশ আজও পাকিস্তানের উপনিবেশ থাকত কিংবা যুদ্ধ চলত বছরের পর বছর। সেখানে খুব কম দেশই একাত্তরে আমাদের সমর্থন দিয়েছিল।
সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশ সেক্যুলার রাষ্ট্র হলেও এখানে ধর্মীয় এবং নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘুরা বাস্তবিক অর্থেই সংখ্যালঘু। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলমান অন্যদের সংখ্যালঘু হিসেবেই বিবেচনা করে। তাই সংখ্যালঘু অধ্যুষিত অঞ্চলে ইকোপার্ক হয়, ‘মূলধারার’ মানুষের এলাকায় বিমানবন্দর হয় না।
অন্য নৃ-গোষ্ঠীগুলোর ব্যাপারে বাঙালির সমষ্টিগত দৃষ্টিভঙ্গির অভিন্ন প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই প্রায় সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে।
আমরা আবেগতাড়িত হয়ে অনেক সময় অনেক কিছু বলি বা করি। কিন্তু সাধারণ মানুষের অবস্থার কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন হয় না। এ কথা বাঙালিদের জন্য যেমন প্রযোজ্য, তেমনি প্রযোজ্য অন্যান্য নৃ-গোষ্ঠীর সদস্যদের জন্যও। জাতিসত্তা ও সাংবিধানিক নিশ্চয়তা থাকলেই সবাই সমানভাবে উন্নয়নের ভাগীদার হন না। দুধের সরটা খেয়ে ফেলে একটা এলিট শ্রেণী। বাংলাদেশ বাঙালির রাষ্ট্র হলেও সব বাঙালি এই রাষ্ট্রের মালিক নয়। অন্যান্য নৃ-গোষ্ঠীর সদস্যরা যেমন জাতিগতভাবে প্রান্তসীমায়, অধিকাংশ বাঙালিও শ্রেণীগতভাবে প্রান্তিক। এই রাষ্ট্র তো সবার নয়। কিন্তু এর মাঝে কথা বলার, কাজ করার, বিকশিত হওয়ার জন্য যে গণতান্ত্রিক স্পেস দরকার, সেই লড়াইয়ে বাঙালি-অবাঙালি সব নৃ-গোষ্ঠীর মানুষকেই এক কাতারে জমায়েত হতে হবে।
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।
mohi2005@gmail.com
----------------------------------------
courtesy: prothom-alo
BD Online News For BD News Lover and all time updare bd news.Just chack this link
ReplyDeleteClick for mobile Apps