Why we want our voice to be heard?

Pages

Thursday, November 10, 2011

MN Larma’s 28th death anniversary today

MN Larma’s 28th death anniversary today


By Jagaran Chakma.


M N Larma

Today, November 10, is the 28th anniversary of death of Manabendra Narayan Larma, popularly known as MN Larma. He was the first elected member of parliament, representing one of the three seats in Chittagong Hill Tracts (CHT).

MN Larma led the Bangladesh parliamentary delegation’s campaign for membership of the Commonwealth and visited the UK in 1972.

Parbattya Chattagram Jana Samhati Samity (PCJSS) has undertaken an elaborate programme to mark the death anniversary of MN Larma, who pioneered the movement for awakening the ethnic groups about establishing their rights in the Chittagong Hill Tracts (CHT).

The programme includes morning procession (prabhat-feri), placing wreaths at the martyr pulpit, children’s art competition, memorial discussion, candle light vigil and hoisting paper balloon.

A leader with far sight, Manabendra’s life was cut short by an assassin’s bullet at a very young age of 44 after he had developed differences among his followers over the course of their struggle for the self rule in the CHT.

MN Larma, who taught his people to raise their head high like the hills they inhabit, dedicated himself to protecting rights of the region’s people, embracing all, be they members of the ethnic communities or Bengalis.

MN Larma, the founder of the PCJSS was elected to the Bangladesh Parliament from the CHT constituency in the first general election held in Bangladesh in the early seventies.

As an elected member of parliament (MP) from the CHT, he demanded constitutional safeguards ensuring the rights of his hill people in the Parliament.

His demands were ignored and never discussed in the Parliament by the ruling party as well as the opposition.

Following his failed efforts, he led a tribal delegation and submitted a written memorandum to Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, the then prime minister of Bangladesh, with four point charter of demands, seeking regional autonomy for the CHT.

As a result, no provision was guaranteed for the Jumma people in the Bangladesh Constitution of 1972. When the Jumma people’s campaign for autonomy movement through democratic means began to gain momentum under the PCJSS, the government went for repressive measures.

MN Larma’s movement was aimed at ensuring rights to self-determination of CHT people including constitutional recognition of the tribal people and freedom of women, and fulfilling the dreams of labourers.

---------------
courtesy: independentbd





স্মরণ

পাথেয় হোক এম এন লারমার পথ

হরি কিশোর চাকমা | তারিখ: ১০-১১-২০১১

এম এন লারমা
এম এন লারমা

মানুষের জন্ম হলে মৃত্যু অনিবার্য। তবে এমন কিছু মানুষের জন্ম-মৃত্যু আসে, যা সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তেমনই একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা, যিনি এম এন লারমা নামেই বেশি পরিচিত। এম এন লারমার জন্ম ও কর্মময় জীবন পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের চিরনিপীড়িত নির্যাতিত আদিবাসী মানুষকে জাগিয়ে তুলে শিক্ষা ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ে সচেতন করেছিলেন। আর তাঁর মৃত্যুর যে ক্ষত, তা কোনো দিনই পূরণ হওয়ার নয়।

আজ ১০ নভেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, সাবেক সাংসদ মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ২৮তম মৃত্যুবার্ষিকী। পার্বত্য চট্টগ্রামের অবিসংবাদিত এই নেতা আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় ১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্বে অপর আট সহকর্মীসহ নিহত হন। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা এই দিনটিকে জুম্ম জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালন করে আসছে।

১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তরাঞ্চল আসন থেকে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এর আগে ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনেও পার্বত্য চট্টগ্রাম আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জয়লাভ করেছিলেন।

এম এন লারমা কর্মজীবনের শুরুতে শিক্ষিত ছাত্র-যুবকদের সংগঠিত করে ‘গ্রামে চলো’ স্লোগান সামনে রেখে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত এলাকায় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও আদিবাসীদের শিক্ষায় মনোনিবেশ করার উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানান। তিনি নিজেও ১৯৬৬ সালে খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উচ্চবিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তবে ১৯৬৯ সালে এলএলবি পাস করার পর চট্টগ্রাম বার কাউন্সিলে যোগদান করেন। প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি আইন পেশায় যুক্ত ছিলেন।

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে সংবিধান প্রণয়নকালে এম এন লারমা পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগণের সাংবিধানিক স্বীকৃতি, পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিশেষ অঞ্চলের মর্যাদা দেওয়ার দাবি এবং পাহাড়িদের বাঙালি হিসেবে জাতীয় পরিচয় নির্ধারণ করার প্রতিবাদ করেন। কিন্তু সংবিধান প্রণয়ন কমিটি তাঁর দাবি ও প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করে। এসব দাবি আদায়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তুলতে ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি গঠন করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি। তিনি হন সমিতির সাধারণ সম্পাদক। পরে ১৯৭৩ সালে জনসংহতি সমিতির সভাপতির দায়িত্ব নেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ঘটলে এম এন লারমা পাহাড়ি ছাত্র-যুবকদের নিয়ে আত্মগোপনে যান। আত্মগোপন অবস্থায় নিজ দলের বিভেদপন্থী একটি অংশের হাতে এম এন লারমা নিহত হন। দাবি আদায়ে সশস্ত্র আন্দোলন গড়ে তুললেও এম এন লারমা সব সময় চেষ্টা করেছিলেন আলোচনার মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের। সেই পথ ধরে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে সই হয় পার্বত্য চুক্তি, যা পরে পার্বত্য শান্তি চুক্তি নামে পরিচিতি পায়। পার্বত্য চুক্তির মাধ্যমে এম এন লারমার স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথের দেখা পেলেও শাসকগোষ্ঠীর নানা ছলচাতুরীতে তা হচ্ছে না। সে কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনপদ আবার অশান্ত হয়ে ওঠার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

এম এন লারমা পারিবারিক গণ্ডি থেকে গণতান্ত্রিক ভাবধারার অধিকারী। ছাত্রজীবন থেকে সমাজ, সংস্কৃতি ও ইতিহাস বিষয়ে সচেতন ছিলেন। তাঁর অনেক সহকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তিনি ছিলেন সব জীবের প্রতি সহানুভূতিশীল ও প্রকৃতিপ্রেমী। ছিলেন পরিবেশ-প্রতিবেশ সচেতন। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের যে গভীর অরণ্যে আত্মগোপনে ছিলেন, তার আশপাশ এলাকা ছিল বনের পশুপাখির অভয়ারণ্য। তিনি সহকর্মীদের কোনো অবস্থাতে বন্য পশুপাখির বিরক্ত বোধ হবে এমন আচরণ করতে বারণ করতেন।

এম এন লারমা ছিলেন খুবই অধ্যবসায়ী। সব সময় থাকতেন পড়াশোনায় নিমগ্ন। এম এন লারমার সহপাঠী বাঘাইছড়ি তুলাবান এলাকার বাসিন্দা বিনয় কুমার খীসা একবার আমাকে জানিয়েছিলেন, পাকিস্তান আমলে চট্টগ্রামের পাথরঘাটার পাহাড়ি হোস্টেল থেকে যখন এম এন লারমাকে গ্রেপ্তার করা হয়, তখনো হাতে ছিল বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতাঞ্জলি। আর প্রয়াত সাংসদ চাইথোয়াই রোয়াজার কাছ থেকে জানতে পেরেছি, জাতীয় সংসদ সদস্য থাকাকালে এম এন লারমাকে সব সময় খুঁজে পাওয়া যেত জাতীয় সংসদ লাইব্রেরিতে।

একটি জাতিকে সচেতন করে তুলতে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি জরুরি, তা হলো শিক্ষা। সেটিই প্রথম করেছিলেন এম এন লারমা। সে কারণে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ-পরবর্তী সময়ে ছাত্র-যুবকদের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা এবং শিক্ষক হিসেবে আত্মনিয়োগ করার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তিনি নিজেও বেছে নিয়েছিলেন শিক্ষকতা পেশা। মূলত সেই সময় থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের শিক্ষার বিস্তার শুরু হয়েছিল।

এম এন লারমা ছিলেন মহান মনের মানুষ। তিনি সবাইকে বিশ্বাস করতেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতিতে যখন অন্তঃকোন্দল শুরু হয়, তখনো তিনি কুচক্রী ও বিভেদপন্থীদের বিশ্বাস করেছিলেন। সে কারণে তিনি দলের মধ্যে ‘ক্ষমা করো ও ভুলে যাও’ নীতি প্রচার করেছিলেন। তবে মানুষের প্রতি তাঁর সেই বিশ্বাস পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে নিয়ে এসেছে কলঙ্কময় অধ্যায়। তাঁরই কিছু বিপথগামী সহকর্মী এই মহান নেতার মহানুভবতার সুযোগ নিয়ে তাঁকে হত্যা করেছিলেন।

হরি কিশোর চাকমা: প্রথম আলোর রাঙামাটি প্রতিনিধি।

-----------------
 courtesy: prothom alo

এম এন লারমার সংগ্রাম ও আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি

লেখক: রোবায়েত ফেরদৌস & শান্তনু মজুমদার  |  বৃহস্পতি, ১০ নভেম্বর ২০১১, ২৬ কার্তিক ১৪১৮ 


আদিবাসীদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামী নেতা এম এন লারমা ২৮ বছর আগে আজকের এই দিনে খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ির গভীর জঙ্গলে নির্মমভাবে নিহত হন। লারমা জন্মেছিলেন মহাপ্রুম গ্রামে ১৯৩৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বরে, পাহাড়ী জনপদের মরণফাঁদ নামে খ্যাত কাপ্তাই হ্রদের অতল জলরাশিতে সে গ্রামটি তলিয়ে গেছে অনেক আগেই। তরুণ বয়সেই তিনি রক্ষণশীল, পরনির্ভরশীল ও সামন্ত নেতৃত্বের বিরোধিতা করে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের অধিকার রক্ষায় সাহসী ভূমিকা রাখেন, অধিকার আদায়ের সংগ্রাম ও জুম্ম যুবশক্তিকে সুশিক্ষায় উদ্বুদ্ধ ও প্রচারের আন্দোলন শুরু করেন। যুবক লারমার গতিশীল চিন্তা কেবল পার্বত্য চট্টগ্রামের ভৌগোলিক সীমার মধ্যে আবদ্ধ ছিল না, তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মুক্তির সঙ্গে পার্বত্যবাসী জনগণের মুক্তি একই তারে বাঁধা এ প্রতীতি তার ছিল। তাই ১৯৫৬ সাল থেকে এম এন লারমা ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনৈতিক জীবনে পদার্পণ করেন। ১৯৫৭ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম পাহাড়ী ছাত্র সম্মেলনের তিনি ছিলেন অন্যতম উদ্যোক্তা। চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে অধ্যয়নের সময় ১৯৫৮ সালে তিনি ছাত্র ইউনিয়নে যোগদান করেন। ১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে জুম্ম জনগণের অস্তিত্ব বিলোপের লক্ষ্যে শাসক শ্রেণীর আগ্রাসী ঔপনিবেশিক তাণ্ডব ও ভ্রান্ত নীতি তাঁকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। এ সময় তিনি কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করেন। ফলে ১৯৬৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি নিবর্তনমূলক আইনে সরকার এম এন লারমাকে গ্রেফতার করে; প্রায় তিন বছর কারাভোগের পর এম এন লারমা ১৯৬৫ সালে মুক্তিলাভ করেন। সে সময় তিনি জুম্ম ছাত্র-যুব সমাজের নিকট ‘গ্রামে চলো’ শ্লোগান তুলে ধরেন। শতাব্দী প্রাচীন শাসনে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা নিদ্রামগ্ন সমাজে ব্যাপক শিক্ষা প্রসার না ঘটালে জুম্ম জনগণকে অধিকার সচেতন করা সম্ভব নয় বলে তিনি ঐতিহাসিক দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। গ্রামে গ্রামে গিয়ে স্কুল প্রতিষ্ঠা করে সাধারণের মাঝে শিক্ষার প্রসার ঘটানোর আহ্বান জানান তিনি। তাঁর সেই যুগান্তকারী আহ্বানে সাড়া দিয়ে শিক্ষিত যুব সমাজের অনেকেই গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতা পেশায় নিজেদের আত্মনিয়োগ করেন। তারা একাধারে শিক্ষকতা করা ও রাজনৈতিক সংগঠনের কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। এম এন লারমা নিজেও ১৯৬৬ সালে খাগড়াছড়ির পার্বত্য জেলার দীঘিনালা উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদে যোগদান করেন। ১৯৭০-এর ঐতিহাসিক জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকা থেকে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিপুল ভোটে জয়যুক্ত হন। এরপর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি যুব সমাজকে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে উত্সাহিত করেন। রক্তাক্ত কিন্তু সদ্য স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ নিয়ে এম এন লারমার ছিল আকাশ সমান স্বপ্ন ও গভীর ভাবনা। তিনি বাংলাদেশের সংবিধান রচনার সময় তাঁর সেই স্বপ্ন বার বার উচ্চারণ করেছিলেন। তিনি বলতেন, দেশের সংবিধান জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বাংলাদেশের আপামর জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করবে এবং সকল প্রকারের জাতিগত-শ্রেণীগত নিপীড়ন, শোষণ-বঞ্চনার অবসান ঘটাবে। তাঁর বুকভরা আশা ছিল সংবিধানে জাতি-শ্রেণী নির্বিশেষে সকলেরই অধিকার সংরক্ষিত হবে এবং ঔপনিবেশিক অপশাসনের সকল কালাকানুন ও দমন-পীড়নের চির অবসান হবে, বিশেষ করে পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক অধীনতা থেকে পাহাড়ী মানুষ পাবে মুক্তির স্বাদ। 

মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা আশা করেছিলেন, জাতিগত নিপীড়ন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী শক্তির প্রতিভূরা জুম্ম জাতির শত বছরের বঞ্চনার বেদনা বুঝবেন। তারই আলোকে পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করে তিনি গণপরিষদে বার বার আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি তুলে ধরেন। কিন্তু সাংসদ ও সংবিধান প্রণয়নকারীরা তাঁর দাবির আসল মর্মার্থ না বুঝতে পেরে এবং এর পেছনে প্রচ্ছন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদ ক্রিয়াশীল আশঙ্কায় এই দাবিকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা দিয়ে প্রত্যাখ্যান করে। বাহাত্তরের সংবিধানে উল্লিখিত হয় যে, বাংলাদেশের নাগরিকগণ জাতি-ধর্ম-লিঙ্গ জাতিসত্তা নির্বিশেষে ‘বাঙালি’ নামে অভিহিত হবে। কিন্তু ‘জুম্ম’ জাতি কখনো ‘বাঙালি’ হতে পারে না। পার্বত্যবাসীরা যেমন ভিন্ন জাতিসত্তার মানুষ, তেমনি তাদের রয়েছে আলাদা ভাষা, স্বতন্ত্র সংস্কৃতি ও পৃথক জীবনাচার। তাই সেদিন তিনি তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে সংসদ অধিবেশন থেকে বের হয়ে আসেন। বারংবার তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানসহ তত্কালীন অনেক মন্ত্রী-নেতার কাছে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্ব-শাসনের কথা তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু তাঁর সব আবেদন-নিবেদন ব্যর্থ হয়ে যায় শাসকবর্গের উগ্র জাতিয়তাবাদী দাম্ভিকতায়। এরই পরিপ্রেক্ষিতেই ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা প্রতিষ্ঠা করলেন জুম্ম জনগণের প্রথম রাজনৈতিক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি। তিনি ছিলেন সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। এই সংগঠনে তিনি জুম্ম জনগণের প্রগতিশীল ও দেশপ্রেমিক অংশকে যুক্ত করেছিলেন। এর অঙ্গসংগঠন পাহাড়ী ছাত্র সমিতি, মহিলা সমিতি, যুব সমিতির মাধ্যমে আপামর জুম্ম জনগণকে তিনি জনসংহতি সমিতির পতাকাতলে সংগঠিত করেন। ১৯৭৩ সালে জনসংহতি সমিতির সভাপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।

১৯৭৩ সালে দেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনসংহতি সমিতির পক্ষে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের উত্তরাঞ্চলে এম এন লারমা ও দক্ষিণাঞ্চল থেকে চাথোয়াই রোয়াজা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং দুইজনই বিপুল ভোটে জয়যুক্ত হন। সংসদ সদস্য হিসাবে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়নসহ দেশের মেহনতি মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পক্ষে ছিলেন বরাবরই সোচ্চার। ১৯৭৪ সালে সরকারের পার্লামেন্টারী প্রতিনিধি হিসাবে লন্ডনে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ সম্মেলনে যোগদান করেন। বরাবরই তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান খুঁজেছেন। ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা পরবর্তী রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে দেশের রাজনীতি নতুন মোড় নিলে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের সকল পথ রুদ্ধ হয়। এই পরিস্থিতিতেই বাধ্য হয়ে তিনি জুম্ম জনগণকে তাদের সমস্যা সমাধানে এবং নিজেদের আত্মরক্ষার্থে অস্ত্র তুলে নেবার আহ্বান জানান। শুরু হয় তাঁর নেতৃত্বে সশস্ত্র আন্দোলন, লক্ষ্য-আধিপত্যবাদী বাঙালির আগ্রাসী শক্তি ও তার প্রতিভূ সেনা কর্তৃত্ব থেকে জুম্ম জাতির মুক্তি ও স্বায়ত্তশাসন অর্জন। কিন্তু যুদ্ধ তিনি শেষ করে যেতে পারেন নি।

আজকের এই মৃত্যুবার্ষিকীতে আদিবাসী ও প্রগতিশীল বাঙালিরা মিলে সেই দাবি পুনর্ব্যক্ত করছি, যে দাবির জন্য লারমা আমৃত্যু সংগ্রাম করেছেন তা হলো—আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি। আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি মানে সংবিধানে আদিবাসীদের জাতিগত, ভাষাগত, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যগত এবং ভূমির ওপর প্রথাগত অধিকারের স্বীকৃতি। একজন চাকমা বা সাঁওতালের জাতিগত পরিচয় কখনো বাঙালি হতে পারে না—১৯৭২ সালের ২৫ অক্টোবর মানবেন্দ্র লারমা তত্কালীন সংসদকে এই ঐতিহাসিক আর নৃবৈজ্ঞানিক সত্যটি বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তখন তাদের সবাইকে বাঙালি হয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। চল্লিশ বছর পর সংশোধিত সংবিধানে আবারও একই ব্যবস্থাপত্র দেয়া হলো যে, বাংলাদেশের জনগণ সবাই জাতি হিসাবে বাঙালি হবেন। পাকিস্তান আমলে পশ্চিমারা আমাদের বলতেন পাকিস্তানি জনগণের জাতি হচ্ছে একটিই—মুসলমান জাতি। আমরা তা মানিনি, আমরা বলেছি, আমরা জাতি হিসাবে কখনোই মুসলিম না, জাতি হিসাবে আমরা অবশ্যই বাঙালি। সরকার ও সাংসদগণ সংবিধান সংশোধনের সময় জাতি ও জাতীয়তা প্রশ্নে বিশ্বের সমসাময়িক জ্ঞান থেকে বিযুক্ত হয়ে যে কাজ করেছেন তা আমাদের গভীরভাবে হতাশ করেছে। আর এটাই সবচেয়ে বড় হতাশার জায়গা—যে বাঙালি ২৪ বছর পাকিস্তানের জাতিগত/ভাষাগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করে নিজের জাতিগত/ভাষাগত পরিচয় অর্জন করেছে, স্বাধীন বাংলাদেশে সেই বাঙালিরাই আদিবাসীদের ওপর জাতিগত/ ভাষাগত নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে। যে বাঙালি ২৪ বছর পাকিস্তানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে গণতন্ত্র অর্জনের জন্য, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেই বাঙালিরাই আদিবাসীদের ওপর সামরিক আধিপত্য বজায় রেখেছে। একসময়কার নির্যাতিত বাঙালি অপরাপর জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে ক্ষমতার প্রশ্নে এখন নির্যাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ। এটাই বোধহয় ইতিহাসের বক্রাঘাত।

আমাদের প্রত্যাশা ছিল শাসকগোষ্ঠী সংবিধানে এই সত্য মেনে নেবে যে, বাংলাদেশ একটি বহু ভাষা, বহু জাতি ও বহু সংস্কৃতির এক বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশ এবং এর মধ্য দিয়ে সকল জাতির পরিচয়, অধিকার ও সংস্কৃতিকে স্থান দেবে; এভাবেই রাষ্ট্র হয়ে উঠবে সবার; কিন্তু দেখি আশার সে রুটিতে লাল পিঁপড়ে। আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালনার যে বহুত্ববাদী নীতি বা বৈচিত্র্যের ভেতরে যে সংহতি তাকে নির্লজ্জভাবে পরিহার করে সংবিধানে ৯ অনুচ্ছেদে যুক্ত করা হয়েছে, ‘ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত একক সত্তা বিশিষ্ট বাঙালী জাতি’র মতো বাক্য। বাংলাদেশ কোনো একক ভাষা বা একক জাতির রাষ্ট্র নয়। বাংলাদেশে বাঙালি ছাড়াও আরো জাতির মানুষ বাস করে এবং তারা বাংলায় নয়, তাদের নিজ নিজ মাতৃভাষায় কথা বলেন। সংশোধিত সংবিধানে এদেশে বসবাসরত অন্য ভাষাভাষীর মানুষের মাতৃভাষাকেও পরিত্যাজ্য ঘোষণা করেছে। সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হলেও অন্য ধর্মগুলোর অস্তিত্ব স্বীকার করেছে কিন্তু দেশের অন্য জাতিসমূহের ভাষার অস্তিত্বের ব্যাপারে সংবিধান শব্দহীন এবং নিশ্চুপ। একুশ আজ বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পেয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসাবে, খুবই ভালো খবর। তবে যে বিষয়টি খোলাসা করা দরকার তা হলো, ২১ ফেব্রুয়ারির এই স্বীকৃতি, বাংলা ভাষার কোনো স্বীকৃতি নয়। এই স্বীকৃতি নিজের ভাষার জন্য বাঙালি জাতির ‘লড়াই’ এর স্বীকৃতি। অর্থাত্ ভাষা বা বাংলা ভাষা এখানে স্বীকৃতি পাচ্ছে না বা এতে প্রমাণ হচ্ছে না বাংলা ভাষা সারা পৃথিবীতে ‘বিশেষ’ মর্যাদার কোনো ভাষা: বরং এতে স্বীকৃতি পেয়েছে ভাষার জন্য বাঙালি জাতির লড়াই। বাঙালি জাতি এর মধ্য দিয়ে ‘মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াকু মানুষ’ হিসাবে পৃথিবীর বুকে ‘বিশেষ’ মর্যাদা পাচ্ছে। আর ভাষার প্রশ্নে এই স্বীকৃতির সত্যিকারের অনুবাদ হলো—পৃথিবীর সব মাতৃভাষাগুলোর রাষ্ট্রীয় এবং সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেয়া। ভাষার সঙ্গে ভাত বা জীবিকার সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ, তাই আদিবাসীদের ভাষায় শিক্ষাদান বা তাদের ভাষা বিকাশে রাষ্ট্রের করণীয় নির্ধারণ আজ জরুরি। বাংলাদেশে বসবাসরত ৫৬টির অধিক জাতিগোষ্ঠীর নাগরিকগণ নিজ নিজ ভাষায় কথা বলেন; এসব ভাষার কোনিটর কী অবস্থা তা জানার জন্য রাষ্ট্রের তরফ থেকে দ্রুত ভাষা জরিপের কাজটি সম্পন্ন করা উচিত। তাদের ভাষা বিকাশের জন্য আদিবাসী ভাষা একাডেমি প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া উচিত। আমরা হয়তো এই সত্যটিই জানি না যে, বাংলার পরে বাংলাদেশে দ্বিতীয় কথ্য ভাষা হচ্ছে সাঁওতাল।

বাংলাদেশে প্রায় ৩০ লাখ আদিবাসী বাস করেন এবং তাদের কাছে সবচেয়ে অবমাননাকর শব্দ হচ্ছে ‘উপজাতি’; আদিবাসীদের কাছে এটি ‘বাতিল’, ‘পশ্চাত্পদ’ ও ‘পরিত্যাজ্য’ একটি শব্দ। বর্তমান সংবিধানে উপজাতি হিসাবে চিহ্নিত করে প্রকারান্তরে তাদেরকে অপমান করা হয়েছে; উপরন্তু বাংলাদেশে বসবাসরত বাঙালি ছাড়াও অপরাপর জাতির পরিচয়কে তুলে ধরতে যেয়ে একইসঙ্গে উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী, সমপ্রদায় ইত্যাদি বিভিন্ন অভিধা ব্যবহার করা হয়েছে যা নিতান্তই হাস্যকর এবং এগুলোর স্পষ্ট কোনো সংজ্ঞায়ন সংবিধানে নেই। এর মধ্য দিয়ে আদিবাসী পরিচয় নির্মাণে পবিত্র সংবিধানে এক ধরনের দ্বিধা আর তালগোল পাকানো হয়েছে। পৃথিবীর অনেক দেশের সংবিধানে আদিবাসীদের পরিচয়, অস্তিত্ব, সংস্কৃতি ও অধিকারের স্বীকৃতি আছে। যেমন আমেরিকা, কানাডা, বলিভিয়া, মেক্সিকো, ব্রাজিল, প্যারাগুয়ে, ইকুয়েডর, ভেনিজুয়েলা প্রভৃতি দেশে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি শুধু নয়, আদিবাসী ভূমি অধিকার ও টেরিটরির মালিকানা পর্যন্ত স্বীকৃতি পেয়েছে। কোনো কোনো দেশে উচ্চতর আদালতের রায় ও নির্দেশনা আছে আদিবাসী অধিকার রক্ষার জন্য। অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে আদিবাসীদের আইনগত অধিকার ও চুক্তি রয়েছে রাষ্ট্র ও আদিবাসীদের মধ্যে। মালয়েশিয়ার আদিবাসী ‘ওরাং আসলি’দের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আইন হয়েছিল ১৯৫৪ সালে ‘অ্যাবরিজিনাল পিপলস্ এ্যাক্ট’ নামে। এমনকি মালয়েশিয়ার হাইকোর্ট আদিবাসীদের পূর্বপুরুষের অধিকৃত ভূমি রক্ষার জন্য রায় দিয়েছিল ২০০২ সালে। ফিলিপাইনে সাংবিধানিকভাবে আদিবাসীরা স্বীকৃত এবং ইনডিজিনাস পিপলস্ রাইটস অ্যাক্ট আছে তাদের। তাছাড়া আদিবাসী বিষয়ক জাতীয় কমিশন আছে ফিলিপাইনে। নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড ও রাশিয়াতে আদিবাসীদের নিজস্ব পার্লামেন্ট আছে। গ্রীনল্যান্ড ডেনমার্কের উপনিবেশ হলেও সেখানে আদিবাসীদের স্বীকৃতি আছে। আফ্রিকার অনেক দেশে আদিবাসীদের সংস্কৃতি ও বৈচিত্র্যের স্বীকৃতি আছে। কোথাও কোথাও বৈষম্যহীনতার কথা বলা আছে। এশিয়ার মধ্যে কম্বোডিয়া, ভারত, চীন, জাপান, মালয়েশিয়া, নেপাল, তাইওয়ান, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, লাওস প্রভৃতি দেশে আদিবাসীরা হয় সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত অথবা রাষ্ট্রের বিভিন্ন আইন ও পলিসি দ্বারা স্বীকৃত। ইন্দোনেশিয়ায় তৃতীয়বার সংবিধান সংশোধনের সময় সাংবিধানিকভাবে আর্টিক্যাল ১৮ আদিবাসীদের অস্তিত্বকে সম্মান প্রদর্শন শুধু করেনি, তাদের প্রথাগত অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। (সূত্র: ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্ক গ্রুপ ফর ইন্ডিজিনাস অ্যাফেয়ার্স)।

বাংলাদেশে হাজং, কোচ, বানাই, মারমা, চাকমা, গারো, সাঁওতাল, উঁরাও, মুন্ডা, খাসিয়া, মনিপুরী, খুমি, খিয়াং, লুসাই, বম, ম্রো ও রাজবংশীসহ বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক আদিবাসী জনগোষ্ঠী বসবাস করেন। তারা তাদের স্বকীয়তা, বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি, সমৃদ্ধ মূল্যবোধ ও ঐতিহ্য দিয়ে আমাদের দেশকে সমৃদ্ধ করেছেন। ভুলে গেলে ভুল হবে যে, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে এ সকল আদিবাসীর রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল অবদান। নিজেদের স্বতন্ত্র পরিচয় বজায় রেখে আদিবাসী জনগণ যাতে সকলের মত সমান মর্যাদা ভোগ করতে পারেন, সেটি নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের কর্তব্য। আমরা মনে করেছিলাম, চল্লিশ বছরে ভূ-রাজনীতির গতিপ্রকৃতি যেমন পাল্টেছে জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা, মন-রুচিও অনেক অনেক পাল্টেছে। তাই এখন যে সংবিধান রচিত হবে তা কেবল ধর্মনিরপেক্ষ হলেই চলবে না, একইসঙ্গে ভাষা নিরপেক্ষ, জাতি নিরপেক্ষ ও লিঙ্গ নিরপেক্ষ  হতে হবে। ভুলে গেলে ভুল হবে যে, বাঙালির একক জাতীয়তাবাদের দেমাগ ইতিপূর্বে রাষ্ট্রীয় শান্তির ক্ষেত্রে বহুবিধ সমস্যাই কেবল পয়দা করেছে, কোনো সমাধান বাতলাতে পারেনি।

শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে এরকম ধারণা কাজ করে যে, একটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য মুছে ফেলতে না পারলে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা জোরদার হয় না। আমরা মনে করি একক জাতীয়তাবাদের প্রাবল্য একটি ভুল প্রমিজ; বরং একটি দেশের জনবিন্যাস, ঐতিহ্য, ভাষা ও কৃষ্টির বহুমুখী বিচিত্র রূপই রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে; এটিই বৈচিত্র্যের ঐকতান বা বহুত্ববাদ—বিউটি অব ডেমোক্রেসি। একক জাতিসুলভ দাম্ভিকতা বাদ দিয়ে দ্রুত এই সত্য বুঝতে পারলে রাষ্ট্রের জন্য বরং ভালো যে, বাংলাদেশ কোনো এক জাতি এক ভাষা আর এক ধর্মের রাষ্ট্র নয়; এটি অবশ্যই একটি বহু জাতি, বহু ভাষা ও বহু ধর্মের রাষ্ট্র; সংবিধানেও এর ইঙ্গিত আছে কারণ সংবিধানে দেশের নাম পিপলস রিপাবলিক বলা হয়েছে, বেঙ্গলি রিপাবলিক বলা হয়নি। আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতিসহ বিভিন্ন দাবি থেকে আমরা তাই এক চুলও সরে আসতে পারি না। খুবই প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন যে, বিচ্ছিন্নতবাদী আসলে কারা? যারা সংবিধানের ভেতর তাদের যথাযথ স্বীকৃতির জন্য লড়াই করছে তারা? নাকি যারা এই স্বীকৃতি না দিয়ে তাদেরকে দূরে ঠেলছে তারা? আমরা মনে করি সংবিধান কোনো ধর্মগ্রন্থ নয়, আমরা চাইলে আবারো একে সংশোধন করতে পারি, ক্ষমতাসীন সরকারের প্রধানমন্ত্রীও তাই বলেছেন। সেই আশায় আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবিসমূহ আবারো তুলে ধরছি: দ্বিধা দোলাচল আর অস্পষ্টতার কুয়াশা সরিয়ে সংবিধানে স্পষ্ট করে বসবাসরত ৫৬টির অধিক আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জাতিসত্তা, ভাষা ও সংস্কৃতির সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা হোক। সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসাবে ‘বাংলাদেশ একটি বহু ভাষা, বহু জাতি ও বহু সংস্কৃতির এক বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশ’—এই বাক্যের সংযোজন করা হোক। সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের বিধিসহ অপরাপর সামপ্রদায়িক শব্দ, বাক্য ও অনুচ্ছেদসমূহ সংশোধন করে সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সংবিধানে সংযোজন করা হোক—‘পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল বিধায় উক্ত অঞ্চলের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অধিকারের নিরাপত্তার জন্য উক্ত অঞ্চল একটি বিশেষ শাসিত আদিবাসী অঞ্চলের মর্যাদা পাবে।’ তিন পার্বত্য জেলার সংসদীয় আসনসমূহসহ দেশের আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে আদিবাসীদের জন্য জাতীয় সংসদের আসন ও স্থানীয় সরকার পরিষদে আসন সংরক্ষণ করা হোক। আইএলও-এর ১০৭ ও ১৬৯ নং কনভেনশন এবং ২০০৭ সালে গৃহীত জাতিসংঘ আদিবাসী জনগোষ্ঠী অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্র মোতাবেক আদিবাসীদের ঐতিহ্যগত ভূমি অধিকারের সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা হোক। সাংবিধানিকভাবে ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বীকৃতি প্রদান করা হোক।

ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতামুখী অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলোকে বলতে চাই, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের এগিয়ে চলার জন্য এবং আদিবাসীদের সমস্যার স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধানের ক্ষেত্রে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির বিষয়টিকে আবারো নতুন করে ভাবুন। সংবিধানের ত্রুটিপূর্ণ সংশোধনের প্রতিক্রিয়া আদিবাসীরা দেখাতে শুরু করেছেন, গণমাধ্যমে আমরা তার প্রতিফলন দেখছি। ৩০ লাখ মানুষের মনে যে ক্ষোভ আর হতাশা সঞ্চারিত হচ্ছে, দ্রুত তা আমলে না নিলে এখান থেকে অতীতের মতো অনাকাঙ্ক্ষিত অনেককিছুই ঘটে যেতে পারে, যা আমরা কেউই চাই না। আমরা এখনও মনে করি বাংলাদেশ একটি বহু জাতির সম্মানজনক অংশীদারিত্বের রাষ্ট্র হিসাবে পরিচিত হওয়ার স্বপ্নকে ধারণ করতে সক্ষম হবে। আমরা চাই দেশে বসবাসকারী সকল জাতির সমান মর্যাদার ভিত্তিতে নতুন করে রচিত হোক আগামীর সংবিধান।
[লেখক : শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়]

No comments:

Post a Comment