Why we want our voice to be heard?

Pages

Saturday, December 4, 2010

দেশহীন মানুষের কথা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ১৩ বছর সঞ্জীব দ্রং |

দেশহীন মানুষের কথা

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ১৩ বছর

সঞ্জীব দ্রং | তারিখ: ০২-১২-২০১০


কয়েক দিন আগে বান্দরবানে গিয়েছিলাম। এক রাতের জন্য। অল্প সময় হলেও শহর ও শহরের বাইরের অনেক মানুষের সঙ্গে দেখা হয়েছে, কথা বলেছি। পাহাড়ি মানুষের মনে গভীর এক হতাশা আমি দেখেছি। প্রায় সবাই বলেছেন, এ সরকারও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি আর যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করবে না। অন্য সরকারের তো এটি করার প্রশ্নই আসে না। তাহলে হিসাবটা দাঁড়াল, পাহাড়ি মানুষের স্বল্প পরিসরের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হচ্ছে না। জাতিসংঘ আদিবাসী অধিকার ঘোষণার এক নম্বর ধারা ছিল, আদিবাসীদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার রয়েছে। 
দ্রুত বদলে যাচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম, সেখানের মানুষের জীবন ও মানচিত্র। বন অনেক আগেই উজাড় হয়ে গেছে। দখলের রাজত্ব চলছে সেখানে। অনেকে বললেন, বান্দরবানে এখন পর্যটকদের ভিড়। বাইরে থেকে প্রবল শক্তিতে ধাবমান নিয়ন্ত্রণহীন এই উন্নয়ন। আদিবাসী পাহাড়িদের জীবন, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ইতিহাস, বন ও ভূমির সঙ্গে মাখামাখি প্রাচীন সভ্যতা আজ ধ্বংসের মুখোমুখি। ‘ডেভেলপমেন্ট ক্যান কিল দি পিপল’ কথাটি এখানে ফলে যাচ্ছে। আগ্রাসী উন্নয়ন মানুষকে, তার নিজস্ব জীবন ও জগৎকে খুন করতে পারে। পাকা রাস্তা চলে যাচ্ছে গভীর জঙ্গলের দিকে। শঙ্খ নদের তীরে গড়ে উঠেছে নতুন নতুন বস্তি। কে একজন বলল, নদীর তীরে অসংখ্য রোহিঙ্গা পরিবারের বসবাস।
অনেক বছর আগে পাহাড়ের মানুষ বলেছিল, এখানে জীবন আমাদের নয়—লাইফ ইজ নট আওয়ার্স। ডেনমার্ক থেকে বেরিয়েছিল বইটি। বইটি পড়লে বোঝা যাবে, একই স্বাধীন দেশের নাগরিকের সঙ্গে রাষ্ট্র ও তার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কেমন অমানবিক ও বর্ণবাদী আচরণ করতে পারে, রাষ্ট্র নিজে দাঁড়িয়ে থেকে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিতে পারে। তার পরও তো চুক্তি হলো কিছু অধিকার দেওয়ার কাগুজে প্রতিশ্রুতি দিয়ে। আজ ওই অঙ্গীকারের ১৩ বছর হয়ে গেল। পাহাড়ের আদিবাসী মানুষ বলছে, চুক্তির মূল বিষয়টিই বাস্তবায়িত হয়নি। পাহাড়ি মানুষের দুঃখ-কষ্ট কমেনি, বরং বেড়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের ‘বিশেষ বৈশিষ্ট্য’ সংরক্ষণের কথা চুক্তির প্রথম দিকেই বলা হয়েছিল। যে কেউ পাহাড়ে বেড়াতে গেলে দেখবেন, পাহাড়ের জীবন এখন লন্ডভন্ড হয়ে গেছে গত ১৩ বছরে। নিজেদের ঐতিহ্যগত ভূমি ফেরত পাওয়া দূরের কথা, এখনো পাহাড়ের মানুষ ভূমি হারাচ্ছে। বান্দরবানে পাহাড়িরা নানাভাবে ভূমি থেকে সরে যাচ্ছে। দূর পাহাড়ের কোলে নতুন নতুন পর্যটনকেন্দ্র শোভা পাচ্ছে নাগরিক মানুষের বিনোদনের জন্য। যারা চুক্তি করেছিল, সেই জনসংহতি সমিতি সংবাদ সম্মেলনের দুই দিন আগে বলেছে, আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদ মূলত অকার্যকর রয়ে গেছে। এত কিছুর পরও আশাহত না হয়ে সমিতি দাবি জানিয়েছে, সরকারের কাছে চুক্তি বাস্তবায়নে সময়সূচিভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের জন্য। আর আদিবাসী মানুষের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। কী কী হয়েছে এবং কী কী বিষয়ে চুক্তি বাস্তবায়িত হয়নি, তার তালিকা দিয়েছে জনসংহতি সমিতি। যা বাস্তবায়িত হয়েছে, তা কেবল কমিটি করে দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ। সেগুলো হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাহাড়িদের মধ্য থেকে একজন প্রতিমন্ত্রী নিয়োগ (পূর্ণমন্ত্রী করা উচিত), প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পুনর্বাসনসংক্রান্ত টাস্কফোর্স পুনর্গঠন ও খাগড়াছড়ি আসন থেকে নির্বাচিত সাংসদকে টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের চেয়ারম্যান নিয়োগ, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক নিয়োগ, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে একজন পাহাড়ি সাংসদকে নিয়োগ এবং একটি ব্রিগেডসহ ৩৫টি অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার। জনসংহতি সমিতি বলছে, বর্তমান মহাজোট সরকার বিগত দুই বছর মেয়াদকালে চুক্তি বাস্তবায়নের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি গঠিত হলেও এ কমিটি কার্যকর ভূমিকা পালন করছে না। মূলত সরকারের সদিচ্ছার অভাবের কারণে চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি অচলাবস্থার মধ্যে রয়েছে।
আরও যা হয়নি তা হলো, আঞ্চলিক পরিষদ আইন যথাযথভাবে কার্যকর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি, এখনো আঞ্চলিক পরিষদের কার্যবিধিমালা প্রণীত হয়নি, আগের মতো তিন পার্বত্য জেলা পরিষদসহ সরকারের অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আঞ্চলিক পরিষদকে অগ্রাহ্য করে চলেছে, ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনের ধারাগুলো এখনো সংশোধন করা হয়নি, অস্থানীয়দের কাছে দেওয়া প্রায় দুই হাজার প্লটের ৫০ হাজার একর ভূমি লিজের মধ্যে এই সরকারের আমলে কাগজে-কলমে ৫৯৩টি প্লট বাতিল করা হয়েছে বলে সরকারিভাবে দাবি করা হলেও বাস্তবে এখনো কোনো ইজারাদার ভূমি দখলি স্বত্ব ছেড়ে দেয়নি, বরং বহাল তবিয়তে আরও পূর্ণোদ্যমে জায়গা-জমি দখল করে বাগানবাগিচা করে চলেছে। অন্যদিকে অধিকাংশ ইজারাদার ইজারা পুনর্বহালের জন্য আবেদন করেছেন এবং নানা অনিয়মের মাধ্যমে পুনর্বহালও করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে প্রত্যাগত ১২ হাজার ২২২ পাহাড়ি শরণার্থী পরিবারের মধ্যে এখনো নয় হাজার ৭৮০ পরিবার তাদের জমি ফেরত পায়নি। পুনর্গঠিত টাস্কফোর্সের দুটি সভা অনুষ্ঠিত হলেও অভ্যন্তরীণ জুম্ম উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। পার্বত্য অঞ্চলের সব চাকরিতে পাহাড়িদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিয়োগ করার বিধান কার্যকর করার ক্ষেত্রে কোনো পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। যে সংগঠন পাহাড়ি মানুষের পক্ষে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, আজ তারা এত দীর্ঘ তালিকা দিয়ে ‘না’ বলছে। এই তালিকাকে ইতিবাচক অর্থে ধরে নিয়ে সরকারের উচিত হবে অর্থপূর্ণ সংলাপ আয়োজন করা। পাহাড়ের মানুষকে আর কত দূরে আপনারা ঠেলে দেবেন? আমি আশা করব, সরকারের মধ্যে শুভবোধের উদয় হবে এবং অচিরেই একটি উচ্চপর্যায়ের সংলাপ অনুষ্ঠিত হবে, যেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজে উপস্থিত থাকবেন।
আজও প্রতিদিনের মতো ভোর হবে পাহাড়দেশে, যেমন ভোর হয়েছিল ১৩ বছর আগে। তখন বুকভরা আশা নিয়ে তারা উৎসব করেছিল। যুদ্ধ শেষে নতুন জীবনের হাতছানি তাদের স্বপ্নকে অনেক উচ্চে নিয়ে গিয়েছিল। শরণার্থী জীবন ছেড়ে হাজার হাজার মানুষ দেশে ফিরে এসেছিল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইউনেসকো শান্তি পুরস্কার পেয়েছিলেন এবং প্যারিসে গিয়ে দলবলসহ পুরস্কার গ্রহণ করেছিলেন। তখন পার্বত্য চুক্তি নিয়ে পত্রপত্রিকায় লেখালেখির কী ছড়াছড়ি। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে কত অনুষ্ঠান। মনে আছে, টিভিতে দেখেছি, পাহাড়ের বুকে নাচছে একদল তরুণ-তরুণী, তাদের মনে কত আনন্দ। বাঙালি শিল্পী ও পাহাড়ি শিল্পী মিলে দ্বৈত কণ্ঠের গানও প্রচারিত হয়েছে তখন অনেকবার টিভিতে। আজ পার্বত্য চুক্তির ১৩ বছর পর এসব মনে পড়ছে আর মন খুব বেদনায় ভারাক্রান্ত হচ্ছে। যে ১০ বছরের শিশু ভারতের শরণার্থী শিবির থেকে বাবা-মায়ের হাত ধরে নদী পার হয়ে জন্মভূমি গ্রামে ফিরে এসেছিল, সে এখন তরুণ। কী হতাশা ও আশাভঙ্গের মধ্য দিয়ে ১৩ বছর পার করে দিল পাহাড়ের মানুষ। এখন পাহাড়ে আদি অধিবাসীরা দিনে দিনে সংখ্যালঘু হয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ের অধিকার দ্রুত চলে যাচ্ছে অন্যের হাতে। 
তবু আবার আমরা আশায় বুক বাঁধি, নিশ্চয় সামনে সুন্দর কোনো দিন আসবে পাহাড়ি মানুষের জীবনে। শেষ পর্যন্ত মানুষকে ভালোবাসার রাজনীতির জয় হবে। মানুষকে ঠকানোর ও প্রতারণার দেশপ্রেমহীন রাজনীতির অবসান হবে, দিনের শেষে জনগণ এটি বুঝতে পারবে, আমরা সবাই মিলেমিশে আমাদের এই ভূখণ্ডকে সব মানুষের জন্য সুন্দর ও বাসযোগ্য করে রেখে যেতে পারব। 
কোনো নাগরিক যদি বলে, ‘জীবন আমাদের নয়’, তখন সবার আগে রাষ্ট্র ও সরকার লজ্জিত হোক। আমাদের জীবন আমাদের হোক।
সঞ্জীব দ্রং: কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী।
e-mail: sanjeebdrong@gmail.com




---------------

courtesy: prothom alo.

No comments:

Post a Comment