Why we want our voice to be heard?

Pages

Saturday, December 4, 2010

সাক্ষাৎকার পাহাড়ে পাহাড়িদের সংখ্যালঘু করা হচ্ছে : সন্তু লারমা

সাক্ষাৎকারপাহাড়ে পাহাড়িদের সংখ্যালঘু করা হচ্ছে : সন্তু লারমা
'মানুষ স্থানান্তর করে ভূখণ্ড বা জাতিকে ধ্বংস করা মানবাধিকারের সবচেয়ে বড় লঙ্ঘন। সেটা যদি আবার সরকারি উদ্যোগে হয় তাহলে মানবাধিকারের লঙ্ঘন হয় সর্বোচ্চ পর্যায়ের, যা পার্বত্য চট্টগ্রামে হরদম হচ্ছে। একসময় শুধু মুসলমানরা সেখানে যেতেন। এখন বাঙালি হিন্দুরাও যাচ্ছেন। পাহাড়ে দিনদিন পাহাড়িদের সংখ্যালঘুতে পরিণত করা হচ্ছে।' পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের ১৩ বছর পূর্তি উপলক্ষে গত মঙ্গলবার রাজধানীর মণিপুরীপাড়ার বাড়িতে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান ও জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমা কালের কণ্ঠকে এসব কথা বলেন। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আশরাফুল হক রাজীব।

কালের কণ্ঠ : চুক্তি স্বাক্ষরের ১৩ বছর পর এর বাস্তবায়নে আপনি কতটা আশাবাদী?
সন্তু লারমা : আমি পুরোপুরি আশাবাদী। সরকার গড়িমসি করলেও চুক্তি বাস্তবায়ন করতে বাধ্য করা হবে। মনে হচ্ছে, আন্দোলন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। আমরা রাতারাতি চুক্তির বাস্তবায়ন চাই না। পর্যায়ক্রমেই করা হোক। কিন্তু তা-ও হচ্ছে না। আসলে চুক্তি বাস্তবায়নে সরকার আন্তরিক নয়। এর পরও আমি আশাবাদী। কারণ সমাজ এগিয়ে যাবে। এটাই স্বাভাবিক।
কালের কণ্ঠ : একসময় সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্যে ছিলেন। আজ নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের কথা বলছেন। কখনোও কি মনে হয়েছে, চুক্তি করে ভুল করেছেন?
সন্তু লারমা : আমি কোনো ভুল করিনি। চুক্তি বাস্তবায়িত হচ্ছে না সেটা আলাদা বিষয়। চুক্তি করতে সরকারকেও অনেক কিছু ছাড় দিতে হয়েছে। আমাদেরকেও ছাড় দিতে হয়েছে। চুক্তি বাস্তবায়ন একটি ধারাবাহিক বিষয়।
প্রশ্ন : একসময় পাহাড় ছিল পাহাড়িদের। তারাই ছিল সেখানকার মূল অধিবাসী। ১৯৭৮ সালের পর পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করে। আজকের পরিস্থিতি কেমন?
উত্তর : সবচেয়ে বাজে অবস্থা এখন। পার্বত্য চট্টগ্রামে আমরা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছি। হিসাব-নিকাশ করতে গেলে পাহাড়ি ৪৫ শতাংশ এবং বাঙালি ৫৫ শতাংশ হবে। এটা হবে নূ্যনতম অনুপাত। মানুষ স্থানান্তর করে ভূখণ্ডকে বা জাতিকে ধ্বংস করা মানবাধিকারের সবচেয়ে বড় লঙ্ঘন। সেটা যদি আবার সরকারি উদ্যোগে হয়, তাহলে মানবাধিকারের লঙ্ঘন হয় সর্বোচ্চ পর্যায়ের। যা পার্বত্য চট্টগ্রামে হরদম হচ্ছে। প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বাঙালিরা রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়িতে যাচ্ছেন পোঁটলা-পুটলি নিয়ে। এসব জেলার বাসস্ট্যান্ডে গেলে নতুন মুখের আনা-গোনা আপনাদের চোখে পড়বেই। একসময় শুধু মুসলমানরা যেতেন। এখন বাঙালি হিন্দুরাও যাচ্ছেন।
প্রশ্ন : ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তিতে যে কমিশন হয়েছে সেই আইনের ২৩টি ধারায় পরিবর্তন বা নতুন করে সংযোজনের কিছু দাবি ছিল আপনাদের। এটা কত দূর?
উত্তর : চুক্তিতেই ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য কমিশন গঠনের কথা ছিল। তার আলোকেই ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন পাস করা হয়। শুরু থেকেই আইনটিতে কিছু ভুল ছিল। সেগুলো সংশোধনের জন্য আমরা প্রথমে ১৯ দফা দাবি দিয়েছিলাম। পরে তা ২৩ দফায় উন্নীত করা হয়। এসব দফার বেশির ভাগই মেনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সরকার। সরকার বলেছে, আইনে সংশোধনী আনা হবে। তবে সংশোধনের প্রক্রিয়া কী অবস্থায় রয়েছে তা আমার জানা নেই।
প্রশ্ন : ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যানকে অপসারণের দাবি জানিয়েছিলেন আপনারা। কমিশনের চেয়ারম্যানের কি আইনের বাইরে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে?
উত্তর : কমিশনের চেয়ারম্যান রাজনৈতিক বক্তব্য দিতে পারেন না। তাঁর আচরণ রাজনীতিবিদদের মতো হতে পারে না। কিন্তু তিনি তা-ই করছেন। আমরা তাঁর অপসারণ চেয়েছি। গত ১০ অক্টোবর রাঙামাটিতে ভূমিমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রীর যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল সেখানে এ বিষয়টি 'দেখার' প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তাঁরা। তাঁদের সেই দেখা কত দূর, বুঝতে পারছি না।
প্রশ্ন : রাঙামাটিতে বিশ্ববিদ্যালয় করার পরিকল্পনা করছে সরকার। আপনারা তার বিরোধিতা করছেন কেন?
উত্তর : হ্যাঁ, আপনি ঠিকই বলেছেন। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতা করছি। এর স্পষ্ট কারণ হলো, পার্বত্য জেলাগুলোর প্রাথমিক, মাধ্যমিক এমনকি উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার কোনো কাঠামো দাঁড়ায়নি। এসব স্তরভিত্তিক শিক্ষায় শত শত সমস্যা। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নেই, বেঞ্চ নেই, অবকাঠামো নেই। একজন শিক্ষার্থী প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোতে না পারলে কিভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুযোগ নেবে? এগুলো দূর না করে কাদের স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয় করা হচ্ছে? সেখানে তো পাহাড়ের ছেলে-মেয়েরা পড়তে পারবে না। সেখানে কেন বিশ্ববিদ্যালয়? এসব সমস্যা দূর করে বিশ্ববিদ্যালয় করা হোক। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। যে জায়গায় বিশ্ববিদ্যালয় করা হবে সেখানে বসতি স্থপনকারীদের উচ্ছেদ করতে হবে। এর আগে পাহাড়িরা তিনবার তাদের ভিটা থেকে উচ্ছেদ হয়েছে। একবার কাপ্তাই বাঁধের জন্য তাদের উচ্ছেদ করা হয়েছে। বিডিআরের জন্য পরেরবার। শেষবার পর্যটনের জন্য তারা উচ্ছেদ হয়। একটি পরিবার যদি তিনবার উচ্ছেদ হয় তাহলে তাদের জীবনে আর থাকে কী? আমরা শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদকে এসব বিষয় জানিয়েছি। আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতা করেছি। আমরা মন্ত্রীকে বলেছি, এই বিশ্ববিদ্যালয় হলে আমাদের কোনো উপকারে আসবে না। বিসিএস পরীক্ষায় আমাদের যে কোটা দেওয়ার বিধান রয়েছে, সেই কোটা পূরণ করা হচ্ছে না। সরকার যদি কোটা পূরণ করত তাহলে পাহাড়িদের ভেতর থেকে অনেকে সরকারি চাকরিতে যেতে পারত।
প্রশ্ন : সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনজন এমপিই প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদার। আপনি কি মনে করেন, এসব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি যদি চেষ্টা করতেন তাহলে কিছু সমস্যার সমাধান করা যেত?
উত্তর : প্রতিমন্ত্রী মর্যাদার এসব নেতারা যদি চেষ্টা করতেন তা হলে কিছু সমস্যার তো সমাধান হতোই। কিন্তু দলীয়করণের জন্য তাঁরা তা করেন না। সব জায়গায় তাঁরা দলের স্বার্থ খোঁজেন। তাঁদের কাছে জনগণের নয়, নিজের স্বার্থ এবং দলের স্বর্থ মুখ্য বিষয়।
প্রশ্ন : সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি জরিপের একটা উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু আপনারা বিরোধিতা করেছেন। কেন?
উত্তর : ভূমি জরিপের বিষয়ে আমাদের অবস্থান স্পষ্ট। এখানে তিনটি বিষয় রয়েছে। চুক্তি বাস্তবায়ন, ভারত প্রত্যাগত এবং অভ্যন্তরীণ শরণার্থীদের পুনর্বাসন এবং ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি। এই তিনটি বিষয় বাস্তবায়নের পর আঞ্চলিক পরিষদের সঙ্গে পরামর্শ করে চুক্তি অনুযায়ী জরিপ করতে হবে। চুক্তি বাস্তবায়ন না করে, শরণার্থীদের ভূমি বুঝিয়ে না দিয়ে কেন জরিপ করবেন? নানা ধাপ পেরিয়ে এরপর জরিপ করতে হবে। জরিপ নিয়ে সরকার নানা টালবাহানা করছে। শেষ পর্যন্ত সরকার ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির পর জরিপ শুরু করার কথা জানিয়েছে গত ১০ অক্টোবরের সভায়।
প্রশ্ন : সাধারণ মানুষের অভিমত শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন করতে না পারায় পাহাড়ে আপনাদের জনপ্রিয়তা কমেছে। আগে থেকেই খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে সাংগঠনিকভাবে আপনারা দুর্বল ছিলেন। এখন সেই দুর্বলতা রাঙামাটিতেও চোখে পড়ছে। আপনি কী মনে করেন?
উত্তর : আমি ঠিক সেভাবে বিষয়টা দেখি না। সরকার চায় জনসংহতি সমিতি ধ্বংস হয়ে যাক। সে জন্যই ইউপিডিএফের জন্ম দেওয়া হয়েছে। তাদের মাধ্যমে সন্ত্রাস করা হচ্ছে। চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে সবার সমর্থনে। চুক্তি কেন বাস্তবায়িত হচ্ছে না তা সবাই জানেন। জনসংহতি সমিতি_জেএসএস দুর্বল হয়ে গেছে, এটা অপপ্রচার। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে জেএসএসকে বিভাজন করার যে ষড়যন্ত্র হয়েছিল তা এখনো অব্যাহত আছে। জেএসএসকে ধ্বংস করার প্রক্রিয়াটি চলমান। সংস্কারপন্থী নামে দু-একজন নিজেদের স্বার্থের কারণে চলে গেছেন। সরেজমিনে গহিন পহাড়ে যান। সেখানে আসল চিত্র পাবেন। জেএসএসের জনপ্রিয়তা সাধারণ মানুষের কাছে এখনো তুঙ্গে। এখনো কমপক্ষে ৯০ শতাংশ পাহাড়ি জেএসএসকে ভালোবাসে। আমাদের কাঠামোগত কিছু দুর্বলতা রয়েছে। এর কারণ হলো ইউপিডিএফ আমাদের কর্মীদের ধরে ধরে নির্যাতন করে। হয়রানি করে। সরকারের বিশেষ মহলের চাপ তো রয়েছেই। বিশেষ মহল কর্মীদের ডেকে বলছে, জেএসএস করা যাবে না। আমি যেখানেই যাই, শত বাধার পরও হাজার হাজার লোক জমায়েত হয়। জেএসএসের সঙ্গে জনগণ রয়েছে। ইউপিডিএফের সঙ্গে কখনোই জনগণ ছিল না। তারা একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী।
প্রশ্ন : আপনি জীবনের দীর্ঘ সময় জঙ্গলে কাটিয়েছেন। কোনো নস্টালজিয়ায় ভোগেন কি?
উত্তর : না, আমি বাস্তববাদী মানুষ। আমি কোনো বিষয়ে স্মৃতিকাতর হই না।
প্রশ্ন : জেএসএস অনেকটাই ব্যক্তি সন্তু লারমা-কেন্দ্রিক। আপনার অবর্তমানে কে জনসংহতি সমিতির নেতৃত্ব দেবেন?
উত্তর : ইদানীং এই প্রশ্নটা অনেকেই করেন। প্রশ্নটা এভাবে করা ঠিক না। কারণ আমাদের নেতৃত্ব নির্ধারিত হয় গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কংগ্রেসে। এখানে ব্যক্তি মুখ্য নন। আমাদের নেতা-নেত্রী হচ্ছেন আদর্শ, ব্যক্তি নন। নেতা কে সেটা নির্ধারণ করবে কংগ্রেস।
কালের কণ্ঠ : কালের কণ্ঠের পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ।
সন্তু লারমা : আপনাদেরও ধন্যবাদ।


No comments:

Post a Comment