'আদিবাসী' নাকি 'ক্ষুদ্র গোত্রজ নৃগোষ্ঠী'?ড. খুরশীদা বেগম বাংলাদেশের শত শত বছরের অধিবাসী, মানব প্রজাতির কয়েকটি রক্তকুলগত (race) গোত্রজ (গোত্রে জাত, সগোত্র, জ্ঞাতি। ইংরেজিতে having common descent or lineage) এবং সেমত স্বতন্ত্র ভাষা (অনেক ক্ষেত্রেই বর্ণমালা নেই বা মৌখিক ভাষা) ও সাহিত্য, সমাজ ও সংস্কৃতির ঐতিহ্যে লালিত বিভিন্ন ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর আত্মপরিচিতি ধারণের স্পর্শকাতর মানবাধিকার বিষয়টির যথার্থ নির্ণয় প্রশ্নে যদি রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে পারিভাষিক শব্দের কোনো ভুল প্রয়োগ ঘটে তবে হিতে বিপরীত ঘটতে পারে বা রাষ্ট্রের নিরাপত্তার সংকট সৃষ্টি হতে পারে। এ ক্ষেত্রে যেহেতু প্রথাগত ও অপ্রথাগত (conventional and non-conventional security) রাষ্ট্র প্রসঙ্গে প্রযোজ্য, সেহেতু বাংলাদেশের সব ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর আত্মপরিচিতির বিষয় বাস্তবতার নিরিখে অর্থপূর্ণ শব্দে রাজনৈতিকভাবে নিষ্পত্তি ও সাংবিধানিকভাবে নিশ্চিতকরণ আবশ্যক।
বাংলাদেশের অধিবাসী জনধারা
বাংলাদেশে প্রায় ১৬ কোটি (মতান্তরে ১৭ কোটি) অধিবাসীর মধ্যে ৯৮ শতাংশ বাঙালি নৃ-গোষ্ঠী এবং দুই শতাংশ বিভিন্ন ক্ষুদ্র গোত্রজ নৃ-গোষ্ঠী। এখানে প্রায় ৪৮/৫০টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী রয়েছে, যেমন গারো, সাঁওতাল, মুরং, চাকমা, ত্রিপুরা, রাখাইন, মণিপুরী ও খাসিয়া। এদের অনেকে প্রধানত মঙ্গোলয়েড নরগোষ্ঠীর শ্রেণীভুক্ত। এরা নিজ প্রজাতি-গোত্রের বাইরে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয় না বললেই চলে। যেজন্য রক্তমিশ্রণ বিশেষ ঘটে না। খ্রিস্ট ধর্মের প্রভাবে এদের কারো কারো নিজস্ব গোত্রীয় সমাজের প্রচলিত ধর্মের ক্ষেত্রে পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। এ ক্ষুদ্র জনধারাগুলো ঐতিহাসিক নানা কারণে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের মানচিত্রে স্থিরীকৃত ভূ-অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছে এবং এখানকার ভূমি, নদী, সাগর, পাহাড়, বনাঞ্চল কিংবা ঝড়-জল-বন্যা, খরা-দখিনা অথবা আন্দোলন-অভ্যুত্থান-বিদ্রোহ ও যুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে শত শত বছর ধরে একাকার হয়ে আছে। এসব জনধারার সবাই বাংলাদেশের ভূমিজ সন্তান। বাংলাদেশ সবার জন্মভূমি, সবারই মাতৃভূমি। এখানে উল্লেখ্য যে এই ক্ষুদ্র জনসত্তাগুলো একে অপরের মধ্যে বা বাঙালিদের সঙ্গে মিশে যায়নি।
অন্যদিকে বাংলা ভূ-অঞ্চলের (বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিম বাংলা) বিশাল বাঙালি একটি মিশ্ররক্ত বা সংকট নৃ-গোষ্ঠী বা বাঙালি বিশ্বে অন্যতম বৃহৎ জনগোষ্ঠী। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিশ্বব্যাপী মানবসমাজের শত শত ভাষা সাহিত্যের মধ্যে বর্তমানে পঞ্চম স্থানে রয়েছে। তবে অকৃত্রিম মাতৃভাষা হিসেবে, অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদী বা ঔপনিবেশিক প্রভাবে গৃহীত ও বিস্তৃত ভাষারূপে নয়, বাংলা ভাষার সংখ্যা বিচারে আরো দুই এক ধাপ ওপরে উঠে যাবে কি না বিশেষজ্ঞরা বলতে পারবেন। বাংলা ভারতবর্ষে দ্বিতীয় বৃহৎ কথ্য ভাষা। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের লেখ্য রূপেরও হাজার বছরের অতীত ইতিহাস রয়েছে। বাংলার ভৌগোলিক অঞ্চলে বাঙালি জনগোষ্ঠীর বসবাসের ইতিহাস অতি সুপ্রাচীন। প্রায় তিন হাজার বছর আগে পবিত্র ঋগ্বেদে 'বঙ্গ' নামে একটি জনধারার উল্লেখ পাওয়া যায়। এই ভূ-অঞ্চলের নামও জনগোষ্ঠীর নাম বাংলা ও বাঙালি রূপে পরস্পর একীভূত। বাঙালির রক্ত সংমিশ্রণগত দেহ ও ভাষার রূপ রূপান্তর বা ক্রমবিকাশ এখানেই ঘটেছে, নাম পরিচয় ইত্যাদিও সামাজিক সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক মিথস্ক্রিয়ায় এখানেই বিবর্তিত ও নির্ধারিত হয়েছে। বাঙালি নৃ-গোষ্ঠীও বাংলার আদি-অকৃত্রিম ভূমিজ সন্তান। বাংলাদেশ বাঙালির বহু প্রাচীন মাতৃভূমি।
প্রশ্ন 'আদিবাসী' কে?
ইতিহাসের তথ্য-রেকর্ড সূত্রে বাংলাদেশের 'অখণ্ড মানচিত্রে' বসবাসকারী বাঙালিসহ প্রায় অর্ধ শতাধিক ক্ষুদ্র গোত্রজ নৃ-গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে কে 'আদিবাসী', কে নয় এ প্রশ্ন অবান্তর। অথচ বাংলাদেশে বাঙালি থেকে পৃথক করে বোঝাতে সব ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীকে এক নামে আদিবাসী বলা হচ্ছে। এই পার্থক্য ইংরেজি ভাষ্যে 'indigenous' ev 'aborigine'' কোনো অর্থেই দাঁড়ায় না, আমেরিকায় অভিবাসনকারী ইংরেজ জনগোষ্ঠী থেকে পৃথক বোঝাতে রেড ইন্ডিয়ান জনগোষ্ঠীকে 'aborigine' বা আদিবাসী বলা অর্থপূর্ণ। ভারত বাংলাদেশের মতো অন্যান্য দেশের বাস্তবতা বিবেচনায় জাতিসংঘ কর্তৃক 'আদিবাসী মর্মে গৃহীত সিদ্ধান্ত পরবর্তীকালে পরিবর্তন করে 'marginal people' জাতীয় কিছু বলা হয়েছে সম্ভবত। জাতিসংঘের এই 'resolution' এক্ষণে হাতে না থাকায় চূড়ান্তরূপে কিছু বলা গেল না। তবে জাতিসংঘ বলুক বা না বলুক, সত্য এই যে বাংলাদেশে ক্ষুদ্র গোত্রজ নৃ-গোষ্ঠীগুলোর জন্য 'আদিবাসী' পরিচিতি আরোপণের কিছু ক্ষতিকর প্রভাব রাষ্ট্রের নিরাপত্তা প্রসঙ্গে অনুধাবনযোগ্য। যতদূর জানা যায়, ১৯৯৩ বা গেল শতকের নব্বইয়ের দশক থেকে এই শব্দ ব্যবহৃত হচ্ছে। বিষয়টি রাজনৈতিক বিশ্লেষণ আবশ্যক।
রাষ্ট্রের বিভিন্ন জনধারা এবং জাতীয় সংহতি
১৯৭২-এর সংবিধানে বাঙালি জাতীয়তাবাদ রাষ্ট্রীয় মূলনীতিরূপে গ্রহণ সূত্রে চাকমা নেতা শ্রী মানবেন্দ্র মারমার সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু তাদের 'বাঙালি হয়ে যাও' বলেছিলেন বলে জানা যায়। বক্তব্যটি প্রায়ই নেতিবাচকভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় উপস্থাপিত হয়। বঙ্গবন্ধু যেহেতু বেঁচে নেই, তাঁর সাক্ষাৎকার সূত্রে এ বক্তব্যের মর্ম উদ্ধার করার অবকাশ নেই। সুতরাং এর নেতিবাচক ও ইতিবাচক দুটো দিক চিন্তা করে সত্য খোঁজা যেতে পারে। নেতিবাচক চিন্তায় বঙ্গবন্ধু বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে 'চাকমা' জনসত্তার বিলুপ্তি চেয়েছিলেন। ইতিবাচক চিন্তায় তিনি সদৃশীকরণ (assimilation)-এর আহ্বান জানিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর মতো প্রাজ্ঞ, উদারপন্থী রাজনৈতিক চারিত্র্যে নেতিবাচক চিন্তা সমর্থন পায় না, বিশেষত যখন ৭ মার্চ ১৯৭১ সালের ভাষণে তাঁকে বলতে শোনা যায়, 'বাঙালি-নন বাঙালি' প্রত্যেকে পরস্পরের ভাই এবং প্রত্যেককে রক্ষার দায়িত্ব প্রত্যেকের।
রাজনীতি শাস্ত্রে পঠিতব্য Race and Ethmic politics-এর বিভিন্ন তত্ত্বসূত্রে কোনো দেশের জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় সদৃশীকরণ একটি কাঙ্ক্ষিত পর্যায়। কেননা এর বিপরীতে রয়েছে, দ্বন্দ্ব-সংঘাত (Conflict)। এটি রাজনৈতিক সংহতি তথা জাতীয় সংহতি (national integration) অর্জনের অন্যতম প্রধান উপাদান।
সংহতি অর্থ সম্যক মিলন। মানুষে মানুষে মিলন। সহজ ভাষায় জাতীয় সংহতি হচ্ছে একটি দেশের ক্ষুদ্র বৃহৎ সব নৃ-গোষ্ঠী, আদিবাসী উপজাতি অভিবাসিত (নাগরিক অধিকারপ্রাপ্ত) জনগোষ্ঠী ধর্ম সম্প্রদায় ইত্যাদি নির্বিশেষে সবার দেশজ ও রাষ্ট্রীয় পরিচিতির নিবিড় বন্ধন, ঐক্য ও সম্প্রীতির দৃঢ় অনুভব, সমস্যা মোকাবিলায় অভিন্ন আধ্যাত্মিক তাড়না, দেশের সম্পদ, সম্ভাবনা ও স্বপ্নের অংশীদারি। বস্তুত জাতীয় সংহতি, রাষ্ট্রের উন্নতি ও অগ্রগতি-প্রগতির সূচক শুধু নয়, এটি রাষ্ট্রের ইস্পাতকঠিন নিরাপত্তার বলয় নিশ্চিত করে। এটি অর্জিত না হলে বা অখণ্ড অটুট জনগণসত্তা নির্মিত না হলে যেকোনো ফাঁক-ফাটল ধরে দেশের অপরাজনৈতিক অংশ বা বহির্বিশ্ব থেকে 'ষড়যন্ত্র' প্রবেশের পথ পায়। রাজনৈতিক সভ্যতা বিকাশের বর্তমান পর্যায়ে রাষ্ট্রব্যবস্থায় বসতিভূমি প্রেম (দেশপ্রেম) ও মানবতাবোধভিত্তিক নাগরিক মূল্যবোধ জাতীয় সংহতির গুরুত্বপূর্ণ আউটপুট।
বাংলাদেশ প্রসঙ্গে পর্যবেক্ষণের বিষয় এই যে, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী সদৃশীকরণ ঘটেছে এবং ঘটছে। চাকমা, ত্রিপুরা, গারো_সব ক্ষুদ্র জনসত্তা অতি অসমভাবে সুবিশাল, সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা শিখেছেন, শিক্ষা-উচ্চশিক্ষা লাভ করছেন, বাঙালি নারী-পুরুষের পোশাক পরছেন, আচার-আচরণ রপ্ত করছেন এবং রাষ্ট্রের সরকারি-বেসরকারি কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত হচ্ছেন। ১৯৭১-পূর্বকালের বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত অবস্থান ক্রমে লুপ্ত হচ্ছে। এই সঙ্গে লক্ষণীয়, তরুণ প্রজন্মের বাঙালি নারী-পুরুষেও ক্ষুদ্র গোত্রজ নৃ-গোষ্ঠীর পোশাক, শিল্প-সংগীতের প্রতি অনুরক্ত হচ্ছে।
বক্ষমাণ নিবন্ধে আলোচনার মূলে ফিরে গিয়ে বলার কথা এই যে, বাংলাদেশ জনজীবনে বিকাশমান এ নাগরিক সমাজের ওপর ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোর এ আদিবাসী শব্দ প্রয়োগের নেতিবাচক কিছু প্রভাব পর্যবেক্ষণের বিষয়। যেমন
এক. জনমনে ইতিহাস অসমর্থিত ভ্রান্তি বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে;
দুই. 'আদিবাসী' ভাবনা থেকে ক্ষুদ্র গোত্রজ নৃ-গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে একরকম অহংবোধ ও বিশাল বাঙালিকে অ-আদিবাসীরূপে প্রশ্নবোধক করে তোলার সম্ভাবনা সৃষ্টি হচ্ছে;
তিন. আদিবাসী ও অ-আদিবাসী হিসেবে নাগরিক জীবনে বিচ্ছিন্নতাবোধ গড়ে উঠতে পারে;
চার. ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোর নতুন প্রজন্মের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত আত্মসচেতনতা লাইনচ্যুত হতে পারে। যেমন নিবন্ধনকারিণী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বাঙালি শিক্ষার্থী জানিয়েছিল, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তার একটি ছোট্ট সমীক্ষা সূত্রে উঠে এসেছে যে, উচ্চশিক্ষার্থী চাকমা ছেলেমেয়েরা দুই-একজন বাদে সবাই বলেছে, তারা বাংলা শিখতে চায় না। বিষয়টি বাস্তবতাবোধবিবর্জিত এ কারণে যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ ইংরেজিভাষী জনগণ অধ্যুষিত যুক্তরাজ্যে বসতির বাস্তব অবস্থায় ইংরেজি ভাষা না শেখা অসংগত। অন্যদিকে কলেজ শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ক্ষেত্রে বক্তৃতাদানকালে একজন নিবন্ধনকারিণীকে প্রশ্ন করেছিলেন, চাকমাদের ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে না কেন? এরূপ ইন্ধনপূর্ণ বক্তব্য ক্ষতিকর, কেননা এ বিষয়টি অর্ধশত প্রায়। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সবার জন্যই প্রযোজ্য। তা ছাড়া রাষ্ট্রভাষার ক্ষেত্রে ভাষার মান ও শক্তি অবধারিত বিষয়।
পাঁচ. বিভিন্ন সময় আলোচনা সূত্রে লক্ষ করা গেছে, কোনো কোনো ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর অঞ্চলগত অধিকারবোধ রাষ্ট্রপক্ষ সমগ্র রাষ্ট্রপক্ষে নাগরিক মূল্যবোধকে ক্ষুণ্ন করে। জ্ঞাতি-গোত্রজ আমরা উপলব্ধি ('We' feelings) স্বাতন্ত্র্য রক্ষার বা পরিচিতি সংরক্ষণের (Preservation of Identity) সহজাত আকাঙ্ক্ষা ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার অতিরিক্ত হওয়া বাঞ্ছনীয় না।
বাংলাদেশের মাটি-ভূমি, পানি, গ্যাস, কয়লা, আকাশ-বাতাস সব কিছু বাংলাদেশের বাঙালিসহ সব ক্ষুদ্র গোত্রজ গোষ্ঠী সবার এবং সকলের। সবার জন্য এসব কিছুর সুষম বণ্টনে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার
নিমিত্তে সুচিন্তিত রাজনৈতিক দর্শন, আদর্শ ও সুস্থ রাজনৈতিক আবহ প্রয়োজন।
বাংলাদেশের গণতন্ত্রে এ রাজনৈতিক সংস্কৃতি নির্মাণের দায় ও দায়িত্বও এ দেশের ক্ষুদ্র-বৃহৎ সব জনধারার অন্তর্গত বিশাল অখণ্ড নাগরিক সমাজের।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় -------- courtesy: the daily kaler kantho
বাংলাদেশের অধিবাসী জনধারা
বাংলাদেশে প্রায় ১৬ কোটি (মতান্তরে ১৭ কোটি) অধিবাসীর মধ্যে ৯৮ শতাংশ বাঙালি নৃ-গোষ্ঠী এবং দুই শতাংশ বিভিন্ন ক্ষুদ্র গোত্রজ নৃ-গোষ্ঠী। এখানে প্রায় ৪৮/৫০টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী রয়েছে, যেমন গারো, সাঁওতাল, মুরং, চাকমা, ত্রিপুরা, রাখাইন, মণিপুরী ও খাসিয়া। এদের অনেকে প্রধানত মঙ্গোলয়েড নরগোষ্ঠীর শ্রেণীভুক্ত। এরা নিজ প্রজাতি-গোত্রের বাইরে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয় না বললেই চলে। যেজন্য রক্তমিশ্রণ বিশেষ ঘটে না। খ্রিস্ট ধর্মের প্রভাবে এদের কারো কারো নিজস্ব গোত্রীয় সমাজের প্রচলিত ধর্মের ক্ষেত্রে পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। এ ক্ষুদ্র জনধারাগুলো ঐতিহাসিক নানা কারণে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের মানচিত্রে স্থিরীকৃত ভূ-অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছে এবং এখানকার ভূমি, নদী, সাগর, পাহাড়, বনাঞ্চল কিংবা ঝড়-জল-বন্যা, খরা-দখিনা অথবা আন্দোলন-অভ্যুত্থান-বিদ্রোহ ও যুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে শত শত বছর ধরে একাকার হয়ে আছে। এসব জনধারার সবাই বাংলাদেশের ভূমিজ সন্তান। বাংলাদেশ সবার জন্মভূমি, সবারই মাতৃভূমি। এখানে উল্লেখ্য যে এই ক্ষুদ্র জনসত্তাগুলো একে অপরের মধ্যে বা বাঙালিদের সঙ্গে মিশে যায়নি।
অন্যদিকে বাংলা ভূ-অঞ্চলের (বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিম বাংলা) বিশাল বাঙালি একটি মিশ্ররক্ত বা সংকট নৃ-গোষ্ঠী বা বাঙালি বিশ্বে অন্যতম বৃহৎ জনগোষ্ঠী। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিশ্বব্যাপী মানবসমাজের শত শত ভাষা সাহিত্যের মধ্যে বর্তমানে পঞ্চম স্থানে রয়েছে। তবে অকৃত্রিম মাতৃভাষা হিসেবে, অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদী বা ঔপনিবেশিক প্রভাবে গৃহীত ও বিস্তৃত ভাষারূপে নয়, বাংলা ভাষার সংখ্যা বিচারে আরো দুই এক ধাপ ওপরে উঠে যাবে কি না বিশেষজ্ঞরা বলতে পারবেন। বাংলা ভারতবর্ষে দ্বিতীয় বৃহৎ কথ্য ভাষা। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের লেখ্য রূপেরও হাজার বছরের অতীত ইতিহাস রয়েছে। বাংলার ভৌগোলিক অঞ্চলে বাঙালি জনগোষ্ঠীর বসবাসের ইতিহাস অতি সুপ্রাচীন। প্রায় তিন হাজার বছর আগে পবিত্র ঋগ্বেদে 'বঙ্গ' নামে একটি জনধারার উল্লেখ পাওয়া যায়। এই ভূ-অঞ্চলের নামও জনগোষ্ঠীর নাম বাংলা ও বাঙালি রূপে পরস্পর একীভূত। বাঙালির রক্ত সংমিশ্রণগত দেহ ও ভাষার রূপ রূপান্তর বা ক্রমবিকাশ এখানেই ঘটেছে, নাম পরিচয় ইত্যাদিও সামাজিক সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক মিথস্ক্রিয়ায় এখানেই বিবর্তিত ও নির্ধারিত হয়েছে। বাঙালি নৃ-গোষ্ঠীও বাংলার আদি-অকৃত্রিম ভূমিজ সন্তান। বাংলাদেশ বাঙালির বহু প্রাচীন মাতৃভূমি।
প্রশ্ন 'আদিবাসী' কে?
ইতিহাসের তথ্য-রেকর্ড সূত্রে বাংলাদেশের 'অখণ্ড মানচিত্রে' বসবাসকারী বাঙালিসহ প্রায় অর্ধ শতাধিক ক্ষুদ্র গোত্রজ নৃ-গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে কে 'আদিবাসী', কে নয় এ প্রশ্ন অবান্তর। অথচ বাংলাদেশে বাঙালি থেকে পৃথক করে বোঝাতে সব ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীকে এক নামে আদিবাসী বলা হচ্ছে। এই পার্থক্য ইংরেজি ভাষ্যে 'indigenous' ev 'aborigine'' কোনো অর্থেই দাঁড়ায় না, আমেরিকায় অভিবাসনকারী ইংরেজ জনগোষ্ঠী থেকে পৃথক বোঝাতে রেড ইন্ডিয়ান জনগোষ্ঠীকে 'aborigine' বা আদিবাসী বলা অর্থপূর্ণ। ভারত বাংলাদেশের মতো অন্যান্য দেশের বাস্তবতা বিবেচনায় জাতিসংঘ কর্তৃক 'আদিবাসী মর্মে গৃহীত সিদ্ধান্ত পরবর্তীকালে পরিবর্তন করে 'marginal people' জাতীয় কিছু বলা হয়েছে সম্ভবত। জাতিসংঘের এই 'resolution' এক্ষণে হাতে না থাকায় চূড়ান্তরূপে কিছু বলা গেল না। তবে জাতিসংঘ বলুক বা না বলুক, সত্য এই যে বাংলাদেশে ক্ষুদ্র গোত্রজ নৃ-গোষ্ঠীগুলোর জন্য 'আদিবাসী' পরিচিতি আরোপণের কিছু ক্ষতিকর প্রভাব রাষ্ট্রের নিরাপত্তা প্রসঙ্গে অনুধাবনযোগ্য। যতদূর জানা যায়, ১৯৯৩ বা গেল শতকের নব্বইয়ের দশক থেকে এই শব্দ ব্যবহৃত হচ্ছে। বিষয়টি রাজনৈতিক বিশ্লেষণ আবশ্যক।
রাষ্ট্রের বিভিন্ন জনধারা এবং জাতীয় সংহতি
১৯৭২-এর সংবিধানে বাঙালি জাতীয়তাবাদ রাষ্ট্রীয় মূলনীতিরূপে গ্রহণ সূত্রে চাকমা নেতা শ্রী মানবেন্দ্র মারমার সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু তাদের 'বাঙালি হয়ে যাও' বলেছিলেন বলে জানা যায়। বক্তব্যটি প্রায়ই নেতিবাচকভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় উপস্থাপিত হয়। বঙ্গবন্ধু যেহেতু বেঁচে নেই, তাঁর সাক্ষাৎকার সূত্রে এ বক্তব্যের মর্ম উদ্ধার করার অবকাশ নেই। সুতরাং এর নেতিবাচক ও ইতিবাচক দুটো দিক চিন্তা করে সত্য খোঁজা যেতে পারে। নেতিবাচক চিন্তায় বঙ্গবন্ধু বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে 'চাকমা' জনসত্তার বিলুপ্তি চেয়েছিলেন। ইতিবাচক চিন্তায় তিনি সদৃশীকরণ (assimilation)-এর আহ্বান জানিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর মতো প্রাজ্ঞ, উদারপন্থী রাজনৈতিক চারিত্র্যে নেতিবাচক চিন্তা সমর্থন পায় না, বিশেষত যখন ৭ মার্চ ১৯৭১ সালের ভাষণে তাঁকে বলতে শোনা যায়, 'বাঙালি-নন বাঙালি' প্রত্যেকে পরস্পরের ভাই এবং প্রত্যেককে রক্ষার দায়িত্ব প্রত্যেকের।
রাজনীতি শাস্ত্রে পঠিতব্য Race and Ethmic politics-এর বিভিন্ন তত্ত্বসূত্রে কোনো দেশের জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় সদৃশীকরণ একটি কাঙ্ক্ষিত পর্যায়। কেননা এর বিপরীতে রয়েছে, দ্বন্দ্ব-সংঘাত (Conflict)। এটি রাজনৈতিক সংহতি তথা জাতীয় সংহতি (national integration) অর্জনের অন্যতম প্রধান উপাদান।
সংহতি অর্থ সম্যক মিলন। মানুষে মানুষে মিলন। সহজ ভাষায় জাতীয় সংহতি হচ্ছে একটি দেশের ক্ষুদ্র বৃহৎ সব নৃ-গোষ্ঠী, আদিবাসী উপজাতি অভিবাসিত (নাগরিক অধিকারপ্রাপ্ত) জনগোষ্ঠী ধর্ম সম্প্রদায় ইত্যাদি নির্বিশেষে সবার দেশজ ও রাষ্ট্রীয় পরিচিতির নিবিড় বন্ধন, ঐক্য ও সম্প্রীতির দৃঢ় অনুভব, সমস্যা মোকাবিলায় অভিন্ন আধ্যাত্মিক তাড়না, দেশের সম্পদ, সম্ভাবনা ও স্বপ্নের অংশীদারি। বস্তুত জাতীয় সংহতি, রাষ্ট্রের উন্নতি ও অগ্রগতি-প্রগতির সূচক শুধু নয়, এটি রাষ্ট্রের ইস্পাতকঠিন নিরাপত্তার বলয় নিশ্চিত করে। এটি অর্জিত না হলে বা অখণ্ড অটুট জনগণসত্তা নির্মিত না হলে যেকোনো ফাঁক-ফাটল ধরে দেশের অপরাজনৈতিক অংশ বা বহির্বিশ্ব থেকে 'ষড়যন্ত্র' প্রবেশের পথ পায়। রাজনৈতিক সভ্যতা বিকাশের বর্তমান পর্যায়ে রাষ্ট্রব্যবস্থায় বসতিভূমি প্রেম (দেশপ্রেম) ও মানবতাবোধভিত্তিক নাগরিক মূল্যবোধ জাতীয় সংহতির গুরুত্বপূর্ণ আউটপুট।
বাংলাদেশ প্রসঙ্গে পর্যবেক্ষণের বিষয় এই যে, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী সদৃশীকরণ ঘটেছে এবং ঘটছে। চাকমা, ত্রিপুরা, গারো_সব ক্ষুদ্র জনসত্তা অতি অসমভাবে সুবিশাল, সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা শিখেছেন, শিক্ষা-উচ্চশিক্ষা লাভ করছেন, বাঙালি নারী-পুরুষের পোশাক পরছেন, আচার-আচরণ রপ্ত করছেন এবং রাষ্ট্রের সরকারি-বেসরকারি কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত হচ্ছেন। ১৯৭১-পূর্বকালের বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত অবস্থান ক্রমে লুপ্ত হচ্ছে। এই সঙ্গে লক্ষণীয়, তরুণ প্রজন্মের বাঙালি নারী-পুরুষেও ক্ষুদ্র গোত্রজ নৃ-গোষ্ঠীর পোশাক, শিল্প-সংগীতের প্রতি অনুরক্ত হচ্ছে।
বক্ষমাণ নিবন্ধে আলোচনার মূলে ফিরে গিয়ে বলার কথা এই যে, বাংলাদেশ জনজীবনে বিকাশমান এ নাগরিক সমাজের ওপর ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোর এ আদিবাসী শব্দ প্রয়োগের নেতিবাচক কিছু প্রভাব পর্যবেক্ষণের বিষয়। যেমন
এক. জনমনে ইতিহাস অসমর্থিত ভ্রান্তি বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে;
দুই. 'আদিবাসী' ভাবনা থেকে ক্ষুদ্র গোত্রজ নৃ-গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে একরকম অহংবোধ ও বিশাল বাঙালিকে অ-আদিবাসীরূপে প্রশ্নবোধক করে তোলার সম্ভাবনা সৃষ্টি হচ্ছে;
তিন. আদিবাসী ও অ-আদিবাসী হিসেবে নাগরিক জীবনে বিচ্ছিন্নতাবোধ গড়ে উঠতে পারে;
চার. ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোর নতুন প্রজন্মের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত আত্মসচেতনতা লাইনচ্যুত হতে পারে। যেমন নিবন্ধনকারিণী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বাঙালি শিক্ষার্থী জানিয়েছিল, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তার একটি ছোট্ট সমীক্ষা সূত্রে উঠে এসেছে যে, উচ্চশিক্ষার্থী চাকমা ছেলেমেয়েরা দুই-একজন বাদে সবাই বলেছে, তারা বাংলা শিখতে চায় না। বিষয়টি বাস্তবতাবোধবিবর্জিত এ কারণে যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ ইংরেজিভাষী জনগণ অধ্যুষিত যুক্তরাজ্যে বসতির বাস্তব অবস্থায় ইংরেজি ভাষা না শেখা অসংগত। অন্যদিকে কলেজ শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ক্ষেত্রে বক্তৃতাদানকালে একজন নিবন্ধনকারিণীকে প্রশ্ন করেছিলেন, চাকমাদের ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে না কেন? এরূপ ইন্ধনপূর্ণ বক্তব্য ক্ষতিকর, কেননা এ বিষয়টি অর্ধশত প্রায়। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সবার জন্যই প্রযোজ্য। তা ছাড়া রাষ্ট্রভাষার ক্ষেত্রে ভাষার মান ও শক্তি অবধারিত বিষয়।
পাঁচ. বিভিন্ন সময় আলোচনা সূত্রে লক্ষ করা গেছে, কোনো কোনো ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর অঞ্চলগত অধিকারবোধ রাষ্ট্রপক্ষ সমগ্র রাষ্ট্রপক্ষে নাগরিক মূল্যবোধকে ক্ষুণ্ন করে। জ্ঞাতি-গোত্রজ আমরা উপলব্ধি ('We' feelings) স্বাতন্ত্র্য রক্ষার বা পরিচিতি সংরক্ষণের (Preservation of Identity) সহজাত আকাঙ্ক্ষা ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার অতিরিক্ত হওয়া বাঞ্ছনীয় না।
বাংলাদেশের মাটি-ভূমি, পানি, গ্যাস, কয়লা, আকাশ-বাতাস সব কিছু বাংলাদেশের বাঙালিসহ সব ক্ষুদ্র গোত্রজ গোষ্ঠী সবার এবং সকলের। সবার জন্য এসব কিছুর সুষম বণ্টনে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার
নিমিত্তে সুচিন্তিত রাজনৈতিক দর্শন, আদর্শ ও সুস্থ রাজনৈতিক আবহ প্রয়োজন।
বাংলাদেশের গণতন্ত্রে এ রাজনৈতিক সংস্কৃতি নির্মাণের দায় ও দায়িত্বও এ দেশের ক্ষুদ্র-বৃহৎ সব জনধারার অন্তর্গত বিশাল অখণ্ড নাগরিক সমাজের।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় -------- courtesy: the daily kaler kantho
No comments:
Post a Comment