সরকারের দুই বছর
পাহাড়িদের অন্তহীন দীর্ঘশ্বাস
ইলিরা দেওয়ান | তারিখ: ২৫-০১-২০১১
জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে মহাজোট সরকারের দুই বছর পেরোল। এই ‘হানিমুন পিরিয়ড’-এ সরকারের সফলতা-ব্যর্থতা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব-নিকাশ মিলিয়ে দেখতে বসেছে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণও। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকারের প্রতি আস্থা রেখে সারা দেশের মতো তিন পার্বত্য জেলার জনগণও মহাজোটের পক্ষে রায় দিয়েছিল। পাহাড়ের মানুষজনকে আকৃষ্ট করেছিল আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির কয়েকটি ধারা। অন্যতম আকর্ষণ ছিল ১৮.১ ধারা, যেখানে বলা হয়, ‘...আদিবাসীদের জমি, জলাধার এবং বন এলাকায় সনাতনি অধিকার সংরক্ষণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণসহ ভূমি কমিশন গঠন করা হবে। সংখ্যালঘু, আদিবাসী ও ক্ষুদ্র নৃ-জাতিগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্যমূলক সকল প্রকার আইন ও অন্যান্য ব্যবস্থার অবসান করা হবে। ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু এবং আদিবাসীদের জন্য চাকরি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হবে।’ এ ছাড়া ১৮.২ ধারায় ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি’ সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করা হবে বলেও প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।
সরকারের দুই বছরের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব মেলাতে গিয়ে পাহাড়ে দীর্ঘশ্বাসের পরিমাণটাই বেশি। এ সময়ে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, তার মধ্যে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি পুনর্গঠন, ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পুনর্বাসনসংক্রান্ত টাস্কফোর্স পুনর্গঠন, ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন পুনর্গঠন উল্লেখযোগ্য। ইতিমধ্যে চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির তিনটি সভা ও টাস্কফোর্সের দুটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু আশ্বাসবাণী ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি নেই। অন্যদিকে ভূমি কমিশন ১৪টি সভা সম্পন্ন করলেও চেয়ারম্যানের স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবের কারণে ভূমি কমিশনের কার্যক্রম শুরু থেকে বিতর্কিত হয়ে আসছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধানের জন্য এ তিনটি কমিটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও এগুলোর পর্যাপ্ত জনবল, কার্যালয়ের সংকটসহ নানা সীমাবদ্ধতা এখনো দূর হয়নি। এ ছাড়া তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডে পরিবর্তন আনা হয়েছে। কিন্তু শুধু এ পুনর্গঠন ও পরিবর্তনে আত্মতুষ্টিতে ভোগার কোনো অবকাশ নেই।
গত ২৬ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির তৃতীয় সভায় কমিটির আহ্বায়ক বেগম সাজেদা চৌধুরী বলেছেন, পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় রোডম্যাপ অনুযায়ী চুক্তির অবাস্তবায়িত বিষয়গুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে (সমকাল, ২৭ ডিসেম্বর ২০১০)। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির পক্ষ থেকে চুক্তি বাস্তবায়নে রোডম্যাপের দাবি জানানো হলেও সরকার কোনো উদ্যোগ নেয়নি। সাজেদা চৌধুরী এটাও বলেছেন, ‘চুক্তি বাস্তবায়নের একদম শেষ পর্যায়ে আমরা পৌঁছেছি, এখন ফলাফল দেখতে চাই।’ জানুয়ারির সংসদ অধিবেশনে পার্বত্য চুক্তির আইনগত ত্রুটি দূর করা হবে বলেও তিনি সভায় আশ্বাস দিয়েছেন। আর আশ্বাসবাণীর মধ্যে আটকে না থেকে আমরাও চুক্তি বাস্তবায়নের চূড়ান্ত ফলাফল দেখতে চাই।
কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য গৃহীত কিছু বিতর্কিত উদ্যোগের ফলে চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে যেমন প্রশ্ন উঠছে, তেমনি পাহাড়ে অস্থিরতাও তৈরি হয়েছে। যেমন, পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের ‘উপজাতি’ হিসেবে উল্লেখ করার নির্দেশ প্রদান, আদিবাসীদের মতামত ছাড়া ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বিল’ পাস, পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য ‘স্ট্র্যাটেজিক ম্যানেজমেন্ট ফোরাম’ গঠনের পরিকল্পনা, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চল ‘ঠেগামুখ’-এ স্থলবন্দর নির্মাণের ঘোষণা, বন বিভাগ কর্তৃক নতুন নতুন জনবসতি এলাকাকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণা, পার্বত্য চট্টগ্রামে আরও তিনটি নতুন ব্যাটালিয়ন ও সেক্টর সদর দপ্তর করার ঘোষণা, পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থানীয় সন্ত্রাস নির্মূলের লক্ষ্যে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সাঁড়াশি অভিযানের ঘোষণা পাহাড়ে নতুন করে আতঙ্ক বাড়াচ্ছে। অন্যদিকে পাহাড়ে মৌলবাদী জঙ্গিঘাঁটি আবিষ্কৃত হওয়ার পরও জঙ্গি দমনে সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই। অন্যদিকে বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা এবং পাহাড়িদের ভূমি বেদখল করার মতো ঘটনাগুলো পাহাড়িদের উৎকণ্ঠা বাড়িয়েই চলেছে।
এ ছাড়া রাঙামাটিতে মেডিকেল কলেজ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার যে প্রক্রিয়া সরকারিভাবে শুরু হয়েছে, এতে এ প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য অধিগ্রহণকৃত এলাকার জনগণ তৃতীয়বারের মতো উচ্ছেদ হওয়ার আতঙ্কে দিনযাপন করছে। পুনঃ উচ্ছেদের বিরুদ্ধে রাঙামাটিতে জনগণ মানববন্ধন করেছে। পাহাড়ি জনগণ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিপক্ষে নয়, তবে যেকোনো উন্নয়ন পরিকল্পনার আগে সেখানকার বাসিন্দাদের মতামত নেওয়া প্রয়োজন। পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের আগে সেখানকার স্কুল-কলেজগুলোর অবকাঠামোগত সংস্কার ও নির্মাণ, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের জন্য আলাদা শিক্ষাকাঠামো প্রস্তুত ও মাতৃভাষায় শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। চুক্তি মোতাবেক প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগকে জেলা পরিষদে হস্তান্তর করা হলেও পাঠ্যসূচি প্রণয়ন, একাডেমিক ক্যালেন্ডার প্রস্তুত করাসহ কিছু বিষয় জেলা পরিষদ দ্বারা পরিচালিত না হওয়ায় অধিকাংশ পাহাড়ি শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে অকালে ঝরে পড়ে।
বন বিভাগ কর্তৃক খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় ছয়টি মৌজায় প্রায় সাড়ে ১২ হাজার একর জমিকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার ফলে এ মৌজাগুলোর লোকজন প্রতিনিয়ত উচ্ছেদ-আতঙ্কে ভুগছে।
বান্দরবানে রুমা গ্যারিসন সম্প্রসারণের জন্য সাড়ে নয় হাজার একর ভূমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে রুমা উপজেলার জনগণ গত বছরের ৮ নভেম্বর এক প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করেছিল। জানা যায়, রুমা গ্যারিসনকে সেনানিবাসে উন্নীত করার জন্য ১৯৭৭ সালে নয় হাজার ৫৬০ একর ভূমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু তৎকালীন ভূমি মন্ত্রণালয় পরিবেশগত দিক বিবেচনা করে এ প্রস্তাবে অনুমোদন দেয়নি। ১৯৯১ সালে পুনরায় অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু করা হলে বেসামরিক প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়, এ অধিগ্রহণের ফলে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন ও বন বিভাগের ব্যাপক জমি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু বিগত জরুরি অবস্থার সময় আবারও এ অধিগ্রহণ প্রক্রিয়াকে সক্রিয় করা হয়েছে। রুমার জনগণ বর্তমানে উচ্ছেদ-আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে।
অন্যদিকে উন্নয়ন ও শান্তির নামে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চল ‘ঠেগামুখ’কে স্থলবন্দর করার প্রস্তাব, বাঘাইছড়ির সাজেক পরিদর্শনে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিওপি বাড়ানোর ঘোষণা, পার্বত্য এলাকাকে সহিংসতা থেকে মুক্ত করতে সমন্বিত গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানোর উদ্যোগ, পার্বত্য অঞ্চলের এনজিও কার্যক্রম নজরদারি, আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ, পার্বত্য জেলাগুলোর সীমানা পুনর্নির্ধারণের লক্ষ্যে ‘স্ট্র্যাটেজিক ম্যানেজমেন্ট ফোরাম’ গঠনের পরিকল্পনা করা হয়, যা পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে।
উন্নয়নের নামে কেবল প্রস্তাব উত্থাপন করেই উদ্যোগ গ্রহণ করলে সমস্যা শুধু জটিল হবে। এ জন্য স্থানীয় জনগণের মতামত ও সম্পৃক্ততা প্রয়োজন। জোরপূর্বক চাপিয়ে দিয়ে নয়, বাস্তবতার নিরিখে পার্বত্য এলাকার উন্নয়নের জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
সবশেষে সরকারের যে উপলব্ধি জাগা জরুরি তা হলো, আর কালক্ষেপণ না করে অনতিবিলম্বে চুক্তি বাস্তবায়নসহ ভূমিবিরোধগুলো সত্বর মিটিয়ে ফেলে পাহাড়ে স্থায়ী শান্তির বীজ বপন করতে হবে। নির্বাচনী অঙ্গীকার পূরণ করে পাহাড়ের মানুষজনের আস্থা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ সরকারকে নিতে হবে।
ইলিরা দেওয়ান: হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক।
ilira.dewan@gmail.com
সরকারের দুই বছরের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব মেলাতে গিয়ে পাহাড়ে দীর্ঘশ্বাসের পরিমাণটাই বেশি। এ সময়ে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, তার মধ্যে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি পুনর্গঠন, ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পুনর্বাসনসংক্রান্ত টাস্কফোর্স পুনর্গঠন, ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন পুনর্গঠন উল্লেখযোগ্য। ইতিমধ্যে চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির তিনটি সভা ও টাস্কফোর্সের দুটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু আশ্বাসবাণী ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি নেই। অন্যদিকে ভূমি কমিশন ১৪টি সভা সম্পন্ন করলেও চেয়ারম্যানের স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবের কারণে ভূমি কমিশনের কার্যক্রম শুরু থেকে বিতর্কিত হয়ে আসছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধানের জন্য এ তিনটি কমিটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও এগুলোর পর্যাপ্ত জনবল, কার্যালয়ের সংকটসহ নানা সীমাবদ্ধতা এখনো দূর হয়নি। এ ছাড়া তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডে পরিবর্তন আনা হয়েছে। কিন্তু শুধু এ পুনর্গঠন ও পরিবর্তনে আত্মতুষ্টিতে ভোগার কোনো অবকাশ নেই।
গত ২৬ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির তৃতীয় সভায় কমিটির আহ্বায়ক বেগম সাজেদা চৌধুরী বলেছেন, পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় রোডম্যাপ অনুযায়ী চুক্তির অবাস্তবায়িত বিষয়গুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে (সমকাল, ২৭ ডিসেম্বর ২০১০)। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির পক্ষ থেকে চুক্তি বাস্তবায়নে রোডম্যাপের দাবি জানানো হলেও সরকার কোনো উদ্যোগ নেয়নি। সাজেদা চৌধুরী এটাও বলেছেন, ‘চুক্তি বাস্তবায়নের একদম শেষ পর্যায়ে আমরা পৌঁছেছি, এখন ফলাফল দেখতে চাই।’ জানুয়ারির সংসদ অধিবেশনে পার্বত্য চুক্তির আইনগত ত্রুটি দূর করা হবে বলেও তিনি সভায় আশ্বাস দিয়েছেন। আর আশ্বাসবাণীর মধ্যে আটকে না থেকে আমরাও চুক্তি বাস্তবায়নের চূড়ান্ত ফলাফল দেখতে চাই।
কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য গৃহীত কিছু বিতর্কিত উদ্যোগের ফলে চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে যেমন প্রশ্ন উঠছে, তেমনি পাহাড়ে অস্থিরতাও তৈরি হয়েছে। যেমন, পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের ‘উপজাতি’ হিসেবে উল্লেখ করার নির্দেশ প্রদান, আদিবাসীদের মতামত ছাড়া ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বিল’ পাস, পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য ‘স্ট্র্যাটেজিক ম্যানেজমেন্ট ফোরাম’ গঠনের পরিকল্পনা, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চল ‘ঠেগামুখ’-এ স্থলবন্দর নির্মাণের ঘোষণা, বন বিভাগ কর্তৃক নতুন নতুন জনবসতি এলাকাকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণা, পার্বত্য চট্টগ্রামে আরও তিনটি নতুন ব্যাটালিয়ন ও সেক্টর সদর দপ্তর করার ঘোষণা, পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থানীয় সন্ত্রাস নির্মূলের লক্ষ্যে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সাঁড়াশি অভিযানের ঘোষণা পাহাড়ে নতুন করে আতঙ্ক বাড়াচ্ছে। অন্যদিকে পাহাড়ে মৌলবাদী জঙ্গিঘাঁটি আবিষ্কৃত হওয়ার পরও জঙ্গি দমনে সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই। অন্যদিকে বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা এবং পাহাড়িদের ভূমি বেদখল করার মতো ঘটনাগুলো পাহাড়িদের উৎকণ্ঠা বাড়িয়েই চলেছে।
এ ছাড়া রাঙামাটিতে মেডিকেল কলেজ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার যে প্রক্রিয়া সরকারিভাবে শুরু হয়েছে, এতে এ প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য অধিগ্রহণকৃত এলাকার জনগণ তৃতীয়বারের মতো উচ্ছেদ হওয়ার আতঙ্কে দিনযাপন করছে। পুনঃ উচ্ছেদের বিরুদ্ধে রাঙামাটিতে জনগণ মানববন্ধন করেছে। পাহাড়ি জনগণ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিপক্ষে নয়, তবে যেকোনো উন্নয়ন পরিকল্পনার আগে সেখানকার বাসিন্দাদের মতামত নেওয়া প্রয়োজন। পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের আগে সেখানকার স্কুল-কলেজগুলোর অবকাঠামোগত সংস্কার ও নির্মাণ, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের জন্য আলাদা শিক্ষাকাঠামো প্রস্তুত ও মাতৃভাষায় শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। চুক্তি মোতাবেক প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগকে জেলা পরিষদে হস্তান্তর করা হলেও পাঠ্যসূচি প্রণয়ন, একাডেমিক ক্যালেন্ডার প্রস্তুত করাসহ কিছু বিষয় জেলা পরিষদ দ্বারা পরিচালিত না হওয়ায় অধিকাংশ পাহাড়ি শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে অকালে ঝরে পড়ে।
বন বিভাগ কর্তৃক খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় ছয়টি মৌজায় প্রায় সাড়ে ১২ হাজার একর জমিকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার ফলে এ মৌজাগুলোর লোকজন প্রতিনিয়ত উচ্ছেদ-আতঙ্কে ভুগছে।
বান্দরবানে রুমা গ্যারিসন সম্প্রসারণের জন্য সাড়ে নয় হাজার একর ভূমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে রুমা উপজেলার জনগণ গত বছরের ৮ নভেম্বর এক প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করেছিল। জানা যায়, রুমা গ্যারিসনকে সেনানিবাসে উন্নীত করার জন্য ১৯৭৭ সালে নয় হাজার ৫৬০ একর ভূমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু তৎকালীন ভূমি মন্ত্রণালয় পরিবেশগত দিক বিবেচনা করে এ প্রস্তাবে অনুমোদন দেয়নি। ১৯৯১ সালে পুনরায় অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু করা হলে বেসামরিক প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়, এ অধিগ্রহণের ফলে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন ও বন বিভাগের ব্যাপক জমি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু বিগত জরুরি অবস্থার সময় আবারও এ অধিগ্রহণ প্রক্রিয়াকে সক্রিয় করা হয়েছে। রুমার জনগণ বর্তমানে উচ্ছেদ-আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে।
অন্যদিকে উন্নয়ন ও শান্তির নামে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চল ‘ঠেগামুখ’কে স্থলবন্দর করার প্রস্তাব, বাঘাইছড়ির সাজেক পরিদর্শনে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিওপি বাড়ানোর ঘোষণা, পার্বত্য এলাকাকে সহিংসতা থেকে মুক্ত করতে সমন্বিত গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানোর উদ্যোগ, পার্বত্য অঞ্চলের এনজিও কার্যক্রম নজরদারি, আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ, পার্বত্য জেলাগুলোর সীমানা পুনর্নির্ধারণের লক্ষ্যে ‘স্ট্র্যাটেজিক ম্যানেজমেন্ট ফোরাম’ গঠনের পরিকল্পনা করা হয়, যা পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে।
উন্নয়নের নামে কেবল প্রস্তাব উত্থাপন করেই উদ্যোগ গ্রহণ করলে সমস্যা শুধু জটিল হবে। এ জন্য স্থানীয় জনগণের মতামত ও সম্পৃক্ততা প্রয়োজন। জোরপূর্বক চাপিয়ে দিয়ে নয়, বাস্তবতার নিরিখে পার্বত্য এলাকার উন্নয়নের জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
সবশেষে সরকারের যে উপলব্ধি জাগা জরুরি তা হলো, আর কালক্ষেপণ না করে অনতিবিলম্বে চুক্তি বাস্তবায়নসহ ভূমিবিরোধগুলো সত্বর মিটিয়ে ফেলে পাহাড়ে স্থায়ী শান্তির বীজ বপন করতে হবে। নির্বাচনী অঙ্গীকার পূরণ করে পাহাড়ের মানুষজনের আস্থা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ সরকারকে নিতে হবে।
ইলিরা দেওয়ান: হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক।
ilira.dewan@gmail.com
-------------
courtesy: prothom-alo (25.01.2011)
No comments:
Post a Comment