শান্তিচুক্তির ১৩ বছর
শক্তিপদ ত্রিপুরা
আজ পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী ও অ-আদিবাসী স্থায়ী বাসিন্দাদের এক ঐতিহাসিক দিন। ১৯৯৭ সালের এই দিনে শেখ হাসিনার সরকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতির মধ্যে ঐতিহাসিক 'পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি' সম্পাদিত হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা কেবল পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের সমস্যা নয়, এটি একটি জাতীয় ও রাজনৈতিক সমস্যা। এ সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে চুক্তি সম্পাদিত হওয়ায় দেশে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শেখ হাসিনার সরকার প্রশংসা লাভ করে। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পাদন করায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইউনেসকো পুরস্কারে ভূষিত হন। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পাদন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। এই ঐতিহাসিক চুক্তির মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের দীর্ঘদিনের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের সমাপ্তি ঘটে। চুক্তি সম্পাদনের পর তা বাস্তবায়নের কার্যক্রম শুরু হয়। চুক্তি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করে। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে একজন আদিবাসীকে নিয়োগ দেয়। সরকার চুক্তি অনুসারে বেশ কিছু অস্থায়ী সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করে। সরকার দাবি করে, পাঁচ শতাধিক ক্যাম্পের মধ্য থেকে ২০০ ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে। জনসংহতি সমিতি ও প্রত্যাগত শরণার্থী পরিবারের কয়েক শ সদস্যকে সরকার পুলিশের চাকরি দেয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বয়স ১৩ বছরে পা দিল। ১৩ বছরে সরকার চুক্তির কিছু বিষয় বাস্তবায়ন করলেও এর মৌলিক বিষয়গুলোয় হাত দিতে পারেনি। পার্বত্য চট্টগ্রামের মৌলিক সমস্যা ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তির জন্য উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেনি। আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য জেলা পরিষদকে ক্ষমতায়ন করা হয়নি। অপারেশন উত্তরণসহ সব অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়নি, পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদ নির্বাচনের লক্ষ্যে স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা তৈরি করা হয়নি, আঞ্চলিক পরিষদ বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়নি। পার্বত্য জেলা পরিষদের কাছে সব বিষয়, কর্ম ও প্রতিষ্ঠান হস্তান্তর করা হয়নি, জুম্ম শরণার্থী, অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু ও প্রত্যাগত জেএসএস সদস্যদের পুনর্বাসন করা হয়নি, চুক্তি মোতাবেক বিভিন্ন আইন প্রণয়ন, সংশোধন ও সংযোজন করা হয়নি ইত্যাদি। চুক্তির গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করা হয়নি।
২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করে। আওয়ামী লীগের এই অঙ্গীকারের পরিপ্রেক্ষিতে আদিবাসী জনগণ তিন পার্বত্য জেলায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে জয়যুক্ত করার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সরকার গঠন করে মহাজোট সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করে। এ লক্ষ্যে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি, ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন ও প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পুনর্বাসনবিষয়ক টাস্কফোর্স গঠন করে। মহাজোট সরকার চুক্তি অনুযায়ী ৩৫টি অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার করে। উল্লেখ্য, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে চুক্তি বাতিলের ঘোষণা দিলেও চুক্তির বাস্তবতা স্বীকার করে জোট সরকার ৬৫টি অস্থায়ী সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করে এবং চুক্তির অন্যান্য বিষয় বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করে। মহাজোট সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে চুক্তি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিলেও ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান চুক্তির বিরোধাত্মক কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করায় এ অঞ্চলে আবার অশান্তির আবহ সৃষ্টি হয়। ভূমি কমিশন চেয়ারম্যানের চুক্তির বিরোধাত্মক কার্যক্রমের পরিপ্রেক্ষিতে ভূমি জরিপ ঘোষণা স্থগিত রেখে চুক্তি মোতাবেক আগে ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তির দাবি জানিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন রাজা, জনসংহতি সমিতিসহ বেশ কয়েকটি সংগঠন ও নাগরিক সমাজ সরকারের কাছে স্মারকলিপি দেয়। ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যানের কার্যকলাপকে কেন্দ্র করে ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি ও চুক্তি বাস্তবায়নের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়।
লক্ষণীয় যে সরকার কর্তৃক বারবার চুক্তি বাস্তবায়নের কথা বলা হলেও কার্যত চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার পাশাপাশি চুক্তির বিরোধাত্মক কার্যকলাপও সমান্তরালভাবে চলছে।
সরকারের মেয়াদ দুই বছর শেষ হয়ে গেল। বাকি তিন বছরের মধ্যে শেষ এক থেকে দেড় বছর সরকারকে বিরোধী দলের আন্দোলন মোকাবিলা ও নির্বাচনী প্রস্তুতির কাজে ব্যস্ত থাকতে হবে। সুতরাং মহাজোট সরকার চুক্তি বাস্তবায়নের সময় পাচ্ছে মাত্র এক থেকে দেড় বছর। এই দেড় বছরে সরকার কি চুক্তি সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করতে পারবে? সরকার যদি আন্তরিক হয়, অবশ্যই তা সম্ভব। কিন্তু সরকার যদি ২৪ মাসের মতো চুক্তি বাস্তবায়ন 'করি করি, না করি না করি' খেলা খেলতে থাকে, তাহলে দেড় বছরে তো নয়ই, দেড় যুগেও এই চুক্তি সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করা যাবে না। পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি দিন দিন খারাপের দিকে ধাবিত হচ্ছে। কথায় বলে, সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়। এখনো সময় রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার। কিন্তু সময়মতো কাজ করা না হলে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার প্রচুর আশঙ্কা রয়েছে। তাই সময় থাকতে চুক্তি বাস্তবায়ন করা জরুরি। চুক্তি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই কেবল পার্বত্য চট্টগ্রামের বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হতে পারে। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে অচিরেই চুক্তি বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি।
জননেত্রী শেখ হাসিনা ২০০৮ সালে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও কর্তৃপক্ষকে চুক্তি বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর এই সাধারণ আহ্বান খুব বেশি কাজে দেয়নি। তাই এই চুক্তি বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিক হস্তক্ষেপ নিতান্ত জরুরি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিকতায় ১৯৯৭ সালে এই চুক্তি সম্পাদন সম্ভব হয়েছিল। আজ এর সফল বাস্তবায়নের প্রশ্নেও প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিক হস্তক্ষেপ অত্যাবশ্যক। চুক্তি বাস্তবায়নের প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনকারী শ্রী জ্যোতিরিন্দ্র লারমার বৈঠক খুবই জরুরি। আমরা দেখেছি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে শ্রী লারমার বৈঠকের পরই কেবল ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পাদন সম্ভব হয়েছিল। আশা করি, অচিরেই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে শ্রী লারমার বৈঠক হবে এবং এই বৈঠকের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সফল ও সম্পূর্ণ বাস্তবায়নের রূপরেখা তৈরি হবে। আমরা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সময়মতো সম্পূর্ণ ও যথাযথ বাস্তবায়ন চাই।
লেখক : রাজনীতিক ও কলাম লেখক
No comments:
Post a Comment