Why we want our voice to be heard?

Pages

Sunday, December 5, 2010

আদিবাসী পাহাড়ে বিশ্ববিদ্যালয় চাই

আদিবাসী

পাহাড়ে বিশ্ববিদ্যালয় চাই


জাগরণ চাকমা | তারিখ: ০৫-১২-২০১০

পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পরিকল্পনা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) বিবেচনাধীন। সরকারেরও এ বিষয়ে আগ্রহ আছে বলেই বিভিন্ন সময়ে শোনা যায়। এ উদ্যোগে পাহাড়ের সাধারণ মানুষের মধ্যে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া হওয়ারই কথা। কেননা গরিব পাহাড়ি পরিবারের পক্ষে ঢাকা, চট্টগ্রাম বা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেমেয়েকে পড়ানো সম্ভব নয়।
বিশ্ববিদ্যালয় এমন একটা জায়গা, যেখানে একজন শিক্ষার্থীর জ্ঞানলাভের সুযোগের সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার সুযোগ তৈরি করে দেয়।
পার্বত্য এলাকার শিক্ষার্থীরা এখনো শিক্ষাদীক্ষায় অনেক পিছিয়ে আছে দেশের যেকোনো এলাকার তুলনায়। স্কুল-কলেজগুলো শিক্ষার মানে এখনো প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার মতো পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেনি। তা ছাড়া কলেজে অনার্স পড়া আর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স পড়ার মধ্যে অনেক পার্থক্য থেকে যায়।
পাহাড়ে অনেক গরিব অথচ মেধাবী ছাত্রছাত্রী আছেন, যাঁদের অভিভাবকের আর্থিক সামর্থ্য নেই বিধায় তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন দেখতে পারেন না। অন্যদিকে অভিভাবকেরাও ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ছেলেমেয়েদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে পারছেন না। পাহাড়ে যদি বিশ্ববিদ্যালয় করা হয়, তাহলে অনেক গরিব মেধাবী ছাত্রছাত্রী নিজের এলাকায় থেকে উচ্চশিক্ষা অর্জনের সুযোগ পাবেন।
এ কথা আমরা সবাই জানি, পাহাড়ে অনেক ক্ষোভ আছে, অবিশ্বাস আছে—যার ফলে বিশ্ববিদ্যালয় হলে পাহাড়ে আরও এক ধরনের জটিলতা হয় কি না, তা নিয়ে কেউ কেউ দ্বিধাগ্রস্ত। কিন্তু তা-ই হবে কি? সবকিছু উপেক্ষা করে পাহাড়ের গরিব ছাত্রছাত্রীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া কি জরুরি না?
বান্দরবানের লেলাং খুমি, তাঁদের সম্প্রদায়ের একমাত্র ও সর্বপ্রথম গ্র্যাজুয়েট। তিনি খুব দরিদ্র পরিবারের সন্তান। তিনি অস্ট্রেলিয়া থেকে পড়াশোনা করে এসে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন তাঁর সম্প্রদায়ের উন্নয়নের কাজে। তাঁকে আমি সালাম জানাই। পার্বত্য এলাকার প্রত্যেক আদিবাসী সন্তানকে লেলাং খুমির মতো করে তৈরি হওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত, যাতে পার্বত্য এলাকার আদিবাসীরা একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারে এবং পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। আমার বিশ্বাস, সুযোগ পেলে আদিবাসীদের মধ্য থেকেও বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো অর্থনীতিবিদ, বিজ্ঞানী বের হয়ে আসতে পারে। সে জন্য প্রতিভা বিকাশের সুযোগ তৈরি করে দিতে উচ্চশিক্ষা অপরিহার্য।
পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান পর্যালোচনা করে দেখলে সেখানে নেতিবাচক কোনো নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না। বরং তার সুফল সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর জীবনে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ে এবং সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখে। ভারতের উত্তর-পূর্ব সেভেন সিস্টার রাজ্যগুলোতে এখন বিশ্ববিদ্যালয় আছে এবং এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশির ভাগ স্থানীয় আদিবাসী ছাত্রছাত্রীরা পড়ার সুযোগ পায়। মেঘালয় রাজ্যের রাজধানী শিলংয়ে নর্থ ইস্ট হিল ইউনিভার্সিটিকে (নেহু) যদি আমরা উদাহরণ হিসেবে নিই, তাহলে আমরা দেখি, সেখানে উত্তর-পূর্ব ভারতের ছাত্রছাত্রীরাই বেশি পড়ার সুযোগ পান। এ বিশ্ব্ববিদ্যালয়ে ৭০ শতাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারী স্থানীয় বাসিন্দাদের থেকে নিয়োগ দেওয়ার বিধানও রয়েছে এবং এর কোনো ব্যতিক্রমও হচ্ছে না।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় হলে সে রকম নিয়ম করা যেতে পারে, যাতে ৮০ শতাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারী আদিবাসী সম্প্রদায় থেকে নিতে হবে। ছাত্রছাত্রী ভর্তির বিষয়টাও তা-ই হওয়া উচিত, ৮০ শতাংশ ছাত্রছাত্রী আদিবাসীদের থেকে ভর্তির সুযোগ দিতে হবে এবং গরিব আদিবাসী ছাত্রছাত্রীদের প্রচুর বৃত্তি দেওয়ার ব্যবস্থাও চালু করা যেতে পারে, যাতে পিছিয়ে পড়া আদিবাসীরা এগিয়ে আসতে পারে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে যোগ্যতা অনুযায়ী আদিবাসীদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে অবশ্যই আদিবাসীদের প্রাধান্য দিতে হবে। ঢাকা বা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত আদিবাসী শিক্ষকদের মধ্য থেকে উপাচার্য নিয়োগ দিতে হবে। প্রয়োজনে অবসরপ্রাপ্ত আদিবাসী বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষকদের মধ্য থেকেও উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে।
ছাত্রছাত্রী ভর্তির ক্ষেত্রে অবশ্যই পিছিয়ে পড়া আদিবাসী যেমন কেয়াং, মুরং, পাংখো, খুমি এবং সমতলের আদিবাসীদের ন্যূনতম অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
এ বিশ্ববিদ্যালয়ে পেশাগত বিষয়, যেমন-আইন, নৃবিজ্ঞান, অর্থনীতি, উন্নয়ন অর্থনীতি, মানবাধিকার, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ, সমাজকর্ম, হোটেল ম্যানেজমেন্ট, পরিবেশবিজ্ঞান, বনবিদ্যা, সাংবাদিকতা ইত্যাদি বিষয় শুরুতেই খুলতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানচর্চা, জ্ঞানার্জন ও মানবিক সত্তাকে বিকশিত করার জায়গা। বিশ্ববিদ্যালয় সব সময় গণতন্ত্রের পক্ষে এবং মানবজাতির উন্নয়নের পক্ষে কাজ করে থাকে। বাংলাদেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীত উদাহরণ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় কখনো সেনাশাসন বা অবৈধ সরকারের পক্ষ নেয় না, বরং সব সময় সেনাশাসনের বিপক্ষে কথা বলে। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আমরা দেখেছি, একমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাই সেনাবাহিনীর অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পেরেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সে সাহস দেখিয়ে প্রমাণ করেছেন, তাঁরা গণতন্ত্রের পক্ষে। এর ফলে অল্পদিনের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে সেনাসদস্যরা সরে যেতে বাধ্য হন।
দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই তৈরি হয়। পার্বত্য এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে ঠিক সেভাবেই নেতৃত্ব তৈরি হবে এবং আদিবাসী ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়তো তা-ই করে দেখাবে, সে প্রত্যাশা সবারই হোক।
জাগরণ চাকমা: সাংবাদিক।
chtjchakma@gmail.com




--------------------

courtesy: prothom-alo.

No comments:

Post a Comment