Why we want our voice to be heard?

Pages

Tuesday, May 31, 2011

স্বীকৃতি বাংলাদেশে কোনো আদিবাসী নেই! - জোবাইদা নাসরীন

স্বীকৃতি

বাংলাদেশে কোনো আদিবাসী নেই!

জোবাইদা নাসরীন | তারিখ: ৩১-০৫-২০১১


বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের বহু আগে থেকেই এ ভূখণ্ডে বিভিন্ন আদিবাসীর বসবাস। তবে এটা জোর দিয়েই বলা যায়, ‘আদিবাসী’ পরিচিতির সঙ্গে তাদের এ দেশে আগে-পরে আগমনের কোনো সম্পর্ক নেই এবং এ ধরনের সম্পর্ক খোঁজাও একটি বিশেষ প্রক্রিয়ার অংশ। এই বিশেষ প্রক্রিয়ার উদ্দেশ্য কী, তা আমরা সবাই কম-বেশি জানি। যদিও সরকারের ঊর্ধ্বতন মহল থেকে শুরু করে নিম্নস্তর পর্যন্ত বেশির ভাগ কর্তাব্যক্তিই এ-জাতীয় সরল সংজ্ঞায়নে ‘আদিবাসী’ শব্দটির অর্থ বের করার চেষ্টা করেন কিংবা অন্যদের বিশ্বাস করাতে চান। আর এই প্রক্রিয়া থেকেই সমস্যার বিস্তার। দিনে দিনে আমাদের কাছে স্পষ্ট হচ্ছে পরিচিতি নির্মাণের রাজনীতির নানা কলাকৌশল। এরই অংশ হিসেবে আর একে ঘিরে সর্বশেষ জাতিসংঘে দেওয়া হলো বাংলাদেশ মিশন প্রতিনিধির বয়ান।


বেশ কিছুদিন থেকে ‘আদিবাসী’ শব্দটিকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রীয়ভাবে এ দেশের আদিবাসী জনগণের পরিচিতি নির্মাণের রাজনীতি জোরদার হয়। রাষ্ট্রের তরফ থেকে সাম্প্রতিক সময়ে এ দেশের আদিবাসীরা তিনটি পরিচিতি পায়। এর একটির সঙ্গে তারা একাত্ম বোধ করে, বাকি দুটির সঙ্গে নয়। বর্তমান সময়ে এ পরিচিতি নির্মাণের বিষয়টি জোরালোভাবে হাজির হয়েছে। তারা চাচ্ছে, আদিবাসী পরিচয়ে তাদের সাংবিধানিক পরিচয় তৈরি হোক। অন্যদিকে সরকারি পক্ষ বলছে অন্য পরিচিতির কথা। এই তর্কে নতুন করে আলোচনার খোরাক জুগিয়েছে ইকবাল আহমেদের বক্তব্য। জাতিসংঘের আদিবাসীবিষয়ক স্থায়ী ফোরামের দশম অধিবেশনে বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি নিউইয়র্কে বাংলাদেশ মিশনের প্রথম সেক্রেটারি ইকবাল আহমেদ বলেছেন, ‘বাংলাদেশে কোনো আদিবাসী মানুষ নাই।’ কিন্তু প্রশ্ন হলো, তাহলে যারা আছে, তারা কারা? তিনি অবশ্য তাঁর বক্তব্যে বিষয়টি খোলাসা করেননি। কোন ক্ষমতাবলে তিনি এমন ধরনের ‘মিসিং আইডেনটিটি’ তৈরি করার মুখপাত্র হলেন? 


গত বছর আদিবাসী বিষয়ে বিতর্কের ঝড় ওঠে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বিলের মাধ্যমে। আদিবাসীরা চেয়েছিল, বিলটির নাম হোক ‘আদিবাসী প্রতিষ্ঠান বিল’। তাদের দাবি অগ্রাহ্য করে বিলটি সংসদে পাস করা হয়। গত বছরের প্রথম দিকেই পার্বত্য চট্টগ্রামকে ঘিরে নির্দেশিত একটি প্রজ্ঞাপনে পাওয়া যায় রাষ্ট্রের ভিন্ন কথন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক ‘গোপনীয়’ হিসেবে প্রেরিত সেই নির্দেশনাটি ছিল অনেকটা এ রকম—কতিপয় বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিক পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত ‘উপজাতীয়’ জনগণকে আদিবাসী বলছে, সেটি সরকারের কাছে অভিপ্রেত নয়। তাই এখন থেকে তাদের ‘উপজাতি’ হিসেবে আখ্যায়িত করার জন্য বলা হয়েছে। তৃতীয় নামকরণটি অবশ্য অনেক দিন থেকেই চলে আসছে। যদিও সরকার এটি মানতে নারাজ। উল্লেখ্য, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতা তাঁদের বিভিন্ন ভাষণ, প্রচারপত্র এবং আদিবাসী দিবসের বিশেষ স্মরণিকায় শুভেচ্ছাবাণীতেও ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। এই অবস্থায় আদিবাসী বিষয়ে রাষ্ট্রীয় ডিসকোর্সটি জানা প্রয়োজন।


শুধু তা-ই নয়, বর্তমান ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকারের প্রধান শরিক দল আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার, শিক্ষানীতি ও সর্বশেষ বাজেটেও আদিবাসী শব্দটি আছে। এ ছাড়া সরকারের মন্ত্রীসহ অনেকেই বিভিন্ন সভা-সমাবেশে আদিবাসী শব্দটিই ব্যবহার করেছেন। মজার বিষয় হলো, নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বিলেও বলা হয়েছে, নৃৃগোষ্ঠী বলতে বাংলাদেশে বসবাসরত আদিবাসীদের বোঝানো হয়েছে। তাহলে কীভাবে একজন সরকারি প্রতিনিধি জাতিসংঘের বিশেষ সেশনে দাঁড়িয়ে বলতে পারেন, বাংলাদেশে কোনো আদিবাসী নেই? তাহলে এই সরকারের এতগুলো গুরুত্বপূর্ণ দলিলে কীভাবে এ প্রত্যয়টি যুক্ত হলো?


আইএলও কনভেনশন অনুযায়ী, আদিবাসী (Indigenous) বলতে যা বোঝানো হয় তা হলো, যেসব জনগোষ্ঠী প্রাক-ঔপনিবেশিক সময় থেকে কোনো অঞ্চলে বসবাস করছে এবং তারা তাদের ভাষা, প্রথা, আইনকানুনসহ সংস্কৃতি অক্ষুণ্ন রেখেছে এবং যারা সে দেশের অধিপতিশীল জনগোষ্ঠীর অংশ নয়, তারাই সে দেশের আদিবাসী বলে বিবেচিত হবে। সে হিসেবে বাংলাদেশে বসবাসরত আদিবাসীরা কেন আদিবাসী হিসেবে চিহ্নিত হবে না, সে বিষয়ে সরকারের বিশদ ব্যাখ্যার প্রয়োজন। সরকার যদি নিজের মতো করে আদিবাসী সংজ্ঞায়ন শুরু করে (যা এরই মধ্যে করা শুরু হয়েছে), তাহলে তো খুবই মুশকিল। মুশকিল বোধ করি নৃবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হিসেবে, সমস্যা বোধ করি একজন নাগরিক হিসেবেও।

আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে ‘উপজাতি’, ‘ট্রাইবাল’, ‘হিলম্যান’—এই নামকরণ সবই ঔপনিবেশিক শাসকদের তৈরি, যে নির্মাণের নির্মমতাকে সঙ্গে নিয়ে এত দিন চলেছে এ দেশের আদিবাসী মানুষ। যার পেছনে কাজ করেছে ‘অন্যতা’র রাজনীতি। স্বাধীন দেশে তো সেটি থাকার কথা নয়। কিন্তু এ ভূখণ্ডেও যে এখনো সেই শাসকদের ভূত চেপে আছে, তা আমরা এ বিষয়ে সরকারের প্রতিনিধিদের বক্তব্য থেকে দেখতে পাচ্ছি। ঔপনিবেশিকতার বীজ এখনো আমাদের মস্তিষ্কে আছে, সেটির প্রমাণ আর কতকাল দিতে হবে? মজার ব্যাপার হলো, সরকার কখনো বলে না, কোন সংজ্ঞায় এ দেশের আদিবাসীরা ‘আদিবাসী’ হিসেবে মর্যাদা পাবে না? কী কারণে বাংলাদেশে এই মানুষদের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া যাবে না? আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিলে সরকারের কী কী সমস্যা আসলে হবে? এগুলো আমাদের জানা প্রয়োজন। ভীষণভাবে জানা প্রয়োজন।

কাকে কী নামে পরিচয় করানো হবে, সে ক্ষেত্রে তার মতামত না নিয়েই কীভাবে একটি দেশের প্রতিনিধি জাতিসংঘের অধিবেশনে এ ধরনের বক্তব্য দিতে পারেন? যদি ধরে নিই, এটি সরকারের বক্তব্য, তাহলে এত দিন বলে আসা এবং নির্বাচনী ইশতেহার, বাজেট ও শিক্ষানীতিতে যোগ হওয়ার পর হঠাৎ কী এমন ঘটল যে সরকারকে বলতে হচ্ছে, এ দেশে কোনো আদিবাসী নেই? সরকারের এই স্ববিরোধিতার পেছনের রাজনীতি আসলে কী? সরকার নিশ্চিতভাবেই জানে, জাতিসংঘে সরকার-প্রতিনিধির এ ঘোষণা বাংলাদেশে বসবাসরত আদিবাসীর পরিচিতির সংকট তৈরি করছে ও করবে। সংকট তৈরি নয়, বরং আদিবাসী হিসেবে পরিচিতি দেওয়াই হবে আদিবাসী মানুষের প্রতি সরকারের সবচেয়ে স্বাধীন ও সম্মানজনক দৃষ্টিভঙ্গি।

জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
zobaidanasreen@gmail.com




-----------------------
courtesy: prothom-alo



1 comment:

  1. Please go through the 2007 Declaration of UN on Ingenious Right, also read the definition of UN C 107 and C 169 then you will understand why it is not safe for Govt to call them Adibashi.

    ReplyDelete