Why we want our voice to be heard?

Pages

Friday, November 12, 2010

শ্রদ্ধাঞ্জলি শহীদ এম এন লারমার সংগ্রাম



শ্রদ্ধাঞ্জলি

শহীদ এম এন লারমার সংগ্রাম

সোহরাব হাসান | তারিখ: ১১-১১-২০১০


গতকাল ৯ নভেম্বর ছিল বিপ্লবী নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ (এম এন) লারমার ২৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁর রাজনীতি ও আন্দোলনের মূল কথা ছিল আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ।
১৯৭২ সালে বাংলাদেশের গণপরিষদে যে সংবিধান পাস হয়, তাতে বাঙালি ছাড়া অন্য কোনো জনগোষ্ঠীর সাংবিধানিক স্বীকৃতি ছিল না।
সংবিধানের ৩ নম্বর ধারায় বলা হয়:
‘বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হইবে, বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাঙালি বলিয়া পরিচিত হইবেন।’
এর প্রতিবাদে ওয়াকআউট করেছিলেন পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর একমাত্র প্রতিনিধি এম এন লারমা। এর আগে খসড়া সংবিধানের ওপর গণপরিষদে যে বিতর্ক হয় তাতে অংশ নিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘সংবিধান হচ্ছে এমন একটা ব্যবস্থা যা অনগ্রসর জাতিকে পিছিয়ে পড়া ও নির্যাতিত নীতিতে অগ্রসর জাতির সঙ্গে সমানতালে এগিয়ে নিয়ে আসার পথ নির্দেশ করবে। কিন্তু বস্তুতপক্ষে এই পেশকৃত সংবিধানে সেই রাস্তার সন্ধান পাচ্ছি না।’
পরিতাপের বিষয়, যে বাঙালি জনগোষ্ঠী বিদেশি আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, অত্যাচার-নির্যাতন ভোগ করেছে; সেই বাঙালি নেতৃত্ব আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জাতিগত অধিকার অস্বীকার করে।
১৯৭৩ সালে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে এম এন লারমার নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল দেখা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে। বাঙালি নেতা ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিকার স্বীকার করেননি। এর আগে প্রধানমন্ত্রী পার্বত্য চট্টগ্রামে এক জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে সবাইকে ‘বাঙালি’ হয়ে যেতে বলেছিলেন।
এম এন লারমা ছিলেন এমন এক নেতা, যিনি শুধু তাঁর জাতিগোষ্ঠীর জন্য সংগ্রাম করেননি, লড়াই করেছেন বাংলাদেশের সব জাতির নিপীড়িত মানুষের জন্য।
এম এন লারমার রাজনীতিতে হাতেখড়ি গেল শতকের পঞ্চাশের দশকে, যখন তিনি স্কুলের ছাত্র। ১৯৫৭ সালে তিনি গড়ে তোলেন পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলন এবং ১৯৫৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেন। এম এন লারমা বরাবর ছিলেন গণমানুষের মুক্তির পক্ষে। সমাজতন্ত্র তথা শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা ছিল তাঁর লক্ষ্য। ১৯৭০ সালে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্তুঙ্গ জোয়ারেও তিনি প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এ থেকে ব্যক্তি ও নেতা এম এন লারমার জনপ্রিয়তা অনুমান করা যায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের অপর জনপ্রতিনিধি রাজা ত্রিদিব রায় পাকিস্তানি শাসকদের সঙ্গে হাত মেলালেও এম এন লারমা থেকে যান তাঁর জনগোষ্ঠীর একজন হয়ে, দেশ ও জনগণের মুক্তির জন্য।
১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি এম এন লারমার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, যার পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হয় পাহাড়ের ১১টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী। স্বাধীন বাংলাদেশে পাহাড়িদের পরাধীনতার কাল শুরু হয়।
এরপর এম এন লারমার নেতৃত্বে পাহাড়ি জনগণের একটি প্রতিনিধিদল প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে সাংবিধানিক স্বীকৃতির জন্য চার দফা দাবিসংবলিত একটি স্মারকলিপি পেশ করেন।
এই দাবি মেনে নেওয়ার মতো ঔচিত্যবোধ বাঙালি নেতাদের তখনো ছিল না, সম্ভবত এখনো নেই।
পঁচাত্তরের পর সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান হাজার হাজার বাঙালিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়ে গিয়ে সেখানকার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করেন। বহু বছর ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিরা আছে, পাহাড়িদের সঙ্গে মিলেমিশেই তারা বসবাস করছিল। কিন্তু জিয়াউর রহমান যাদের ‘হিজরত’ করালেন, তাদের একাংশ লুটপাট, জবরদখল শুরু করে।
পঁচাত্তরের ১৬ আগস্ট এম এন লারমা আত্মগোপনে চলে যান, জনসংহতি সমিতি প্রস্তুতি নিতে থাকে সম্ভাব্য আক্রমণ মোকাবিলার। গড়ে তোলেন শান্তিবাহিনী— জনসংহতির সামরিক শাখা।
পরের ইতিহাস সবার জানা। কর্ণফুলীর স্রোতে মিশে গেছে অসংখ্য পাহাড়ি ও বাঙালির রক্ত। রাষ্ট্রের ভুল সিদ্ধান্তে রক্তাক্ত হয়েছে পাহাড়ের সবুজ ভূমি, চিরকাল পাশাপাশি বাস করা পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যকার সম্প্রীতির বন্ধন টুটে গেছে। বেড়েছে হিংসা ও হানাহানি। সেনাবাহিনী শান্তিবাহিনীকে মেরেছে। শান্তিবাহিনী পাল্টা আঘাত হেনেছে। এ কাহিনি প্রায় দুই দশকের। কত প্রাণ ঝরে গেছে, কত শিশু বাবাকে হারিয়েছে, কত স্ত্রী বিধবা হয়েছেন, কত নারী-পুরুষ উদ্বাস্তু হয়েছেন, কত ঘরবাড়ি লুট হয়েছে তার হিসাব নেই। কোনো জাতিগোষ্ঠীর ক্ষতি শুধু সংখ্যা দিয়ে পরিমাপ করা যায় না। প্রতিটি মৃত্যুর পেছনে থাকে অপূরণীয় বেদনা, অপরিসীম কষ্ট ও হাহাকার।
অন্যান্য আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টিতে যেমন অন্তর্দলীয় বিরোধ দেখা দেয়, জনসংহতি সমিতিও তার ব্যতিক্রম ছিল না। একদিকে এম এন রায় গ্রুপ, অন্যদিকে প্রীতি গ্রুপ। বিদেশি বন্ধুরা নাকি এ বিরোধকে আরও উসকে দিয়েছিল। হায় রাজনীতি! হায় ক্ষুদ্র স্বার্থ! শেষ পর্যন্ত প্রতিপক্ষ গ্রুপের হাতে জীবন দিতে হয় এম এন রায়কে, ১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর। এ-ও এক শহীদী মৃত্যু।
কিন্তু তাঁর সংগ্রাম ও সাধনা বৃথা যায়নি। যে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি লড়াই করেছিলেন, তাদের কিছুটা হলেও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মিলেছে। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার পাহাড়িদের দাবি স্বীকার করে নিয়ে সই করে পার্বত্য চুক্তি, যাতে পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিশেষ অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। কিন্তু সাংবিধানিক স্বীকৃতি এখনো মেলেনি।
পৃথিবীর অনেক দেশের সংবিধানে আদিবাসীদের পরিচয়, অস্তিত্ব, সংস্কৃতি ও অধিকারের স্বীকৃতি আছে। যেমন আমেরিকা, কানাডা, বলিভিয়া, মেক্সিকো, ব্রাজিল, প্যারাগুয়ে, ইকুয়েডর, ভেনেজুয়েলা প্রভৃতি দেশে আদিবাসীরা সাংবিধানিক স্বীকৃতি শুধু নয়, আদিবাসী ভূমি অধিকার স্বীকৃতি পেয়েছে। কোনো কোনো দেশে উচ্চতর আদালতের রায় ও নির্দেশনা আছে আদিবাসী অধিকার রক্ষার জন্য। অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে আদিবাসীদের আইনগত অধিকার এবং চুক্তি রয়েছে রাষ্ট্র ও আদিবাসীদের মধ্যে।
সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে বাধা কোথায়?
আমরা আশা করব, সংবিধান সংশোধনে গঠিত বিশেষ কমিটি সংবিধান পুনর্মুদ্রণের আগেই আদিবাসীদের স্বীকৃতির বিষয়টি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে। প্রয়োজনে তারা সংসদে সংবিধান সংশোধন করার প্রস্তাব উত্থাপন করবে।
মনে রাখতে হবে, দেশটি কেবল বাঙালির নয়, জাতি-ধর্ম-বর্ণর্ নির্বিশেষে সবার।

No comments:

Post a Comment