Why we want our voice to be heard?

Pages

Saturday, November 27, 2010

পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার বাস্তবায়ন চাই ইলিরা দেওয়ান | তারিখ: ২০-১১-২০১০

পার্বত্য চট্টগ্রাম
প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার বাস্তবায়ন চাই

ইলিরা দেওয়ান | তারিখ: ২০-১১-২০১০


‘সরকারের প্রতি আস্থা রেখে যাঁরা অস্ত্র সমর্পণ ও চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন, আমরা তাঁদের বিশ্বাস ভঙ্গ করতে পারি না’—প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যের পর পাহাড়িরা আবার কিছুটা আশার আলো দেখছে (প্রথম আলো, ২২ অক্টোবর ২০১০)। তিনি সম্প্রতি এ কথা বলেন যখন জাতীয় সংসদের উপনেতা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক সাজেদা চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যায়। এ ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামে আগে ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি পরে জরিপ করা হবে বলে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন। মহাজোটের নির্বাচনী ইশতেহারে আদিবাসীবিষয়ক অধিকার সংরক্ষণের অঙ্গীকার থাকায় ক্ষমতায় আরোহণের পর স্বাভাবিকভাবে চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়নের একটা সম্ভাবনার ঝিলিক দেখা গিয়েছিল। সে লক্ষ্যে চুক্তি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক কয়েকটি পদ ও কমিটি পুনর্গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু এসব কমিটির কর্মকাণ্ডের উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি এখন পর্যন্ত পরিলক্ষিত হচ্ছে না। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন তার কার্যক্রম জোরেশোরে শুরু করলেও শুরু থেকেই বিভিন্ন বিতর্কের জন্ম দিয়ে চুক্তি বাস্তবায়নের ধারাকে বাধাগ্রস্ত করেছে বলে অনেকে মনে করে।
আগে ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি পরে জরিপ—প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণার আগে গত ২৫ অক্টোবর রাঙামাটিতে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে ভূমিসংক্রান্ত এক আলোচনা সভায় ভূমিমন্ত্রী, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী, আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান, সার্কেল-প্রধানেরাসহ পার্বত্য জেলা পরিষদগুলোর চেয়ারম্যানরা ও সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এ সভার আলোচনায় সরকারপক্ষ ও পাহাড়ি নেতারা উভয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। দেরিতে বোধোদয় হলেও এ আয়োজনের জন্য সরকারপক্ষকে সাধুবাদ জানাতে হয়। কেননা ভূমিকে কেন্দ্র করে পার্বত্য ভূমি কমিশন এযাবৎ ডজন খানেক সভা সম্পন্ন করলেও নিষ্ফল সভাগুলো কেবল জনমনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছিল। এতে জনগণের মাঝে যেমন ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছিল, তেমনই চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের সদিচ্ছার ব্যাপারেও জনগণ আস্থা হারিয়ে ফেলছিল। কিন্তু পরপর দুটি আন্তরিক আলোচনা পাহাড়ের গুমোট পরিস্থিতিকে অনেকখানি সহজ করে দিয়েছে। সরকার, প্রশাসন এবং চুক্তি বাস্তবায়নে নিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো আন্তরিক হলে চুক্তি বাস্তবায়নের পথটি অনেকাংশে মসৃণ হবে। আগে চুক্তি বাস্তবায়নের প্রতিবন্ধক হিসেবে পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে দোষারোপ করা হতো। কিন্তু এখন সেখানে বিদ্যমান সব দলই চুক্তি বাস্তবায়নের দাবি তুলছে। কাজেই বর্তমানে সরকারের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতাই চুক্তি বাস্তবায়নে প্রধান নিয়ামক।
২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘বর্তমান সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ’ (প্রথম আলো, ৩০ এপ্রিল ২০০৯)। এ ঘোষণার দেড় বছর পর প্রধানমন্ত্রী আবারও চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করলেন। চুক্তি স্বাক্ষরের ১৩ বছর পরও যখন চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য পাহাড়ি জনগণকে দাবি জানাতে হয়, আন্দোলন করতে হয়, তখন মনে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, প্রধানমন্ত্রীর বারবার ঘোষণায় পাহাড়িদের মনে আর কতটা আস্থা অটুট আছে! কিন্তু তবুও প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর পাহাড়িরা নতুনভাবে আশ্বস্ত হচ্ছেন এবং সম্ভাবনার আলো দেখতে পাচ্ছেন। এটাকে চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ বলে পাহাড়ীরা মনে করে। পাহাড়ের শান্তিপ্রিয় মানুষজনের একটাই প্রত্যাশা—আর অঙ্গীকার বাণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে চুক্তির অমীমাংসিত বিষয়গুলোর দ্রুত নিষ্পত্তি করে পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি ফিরিয়ে আনা হোক।
তবে সরকারের কর্মপরিকল্পনার অগ্রাধিকার তালিকায় চুক্তি বাস্তবায়নের বিষয়টি কোন পর্যায়ে রয়েছে, সেটিও একটি বিবেচ্য বিষয়। এ ছাড়া প্রায় ১৩ বছর আগে করা চুক্তিটি বর্তমান বাস্তবতার মধ্যে কীভাবে সমন্বয় সাধন করা যায় সে বিষয়গুলোও সামনে নিয়ে আসতে হবে।
বর্তমানে সরকার বলছে, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বার্থে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে ছোটখাটো যেসব সমস্যা রয়েছে সেগুলো দূর করা হবে। এ ছাড়া পার্বত্য অঞ্চলের আইন প্রণয়ন ও সংশোধনে আঞ্চলিক পরিষদের পরামর্শ দেওয়ার এখতিয়ারের কথাও বলা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে আঞ্চলিক পরিষদ কর্তৃক প্রস্তাবিত ভূমি কমিশন আইনের ২৩টি সংশোধনী প্রস্তাবের আলোকে ভূমি কমিশন আইনে সংশোধনী আনা হবে বলে জানানো হয়। কিন্তু এসব ইতিবাচক পদক্ষেপ যদি আরও আগে নেওয়া হতো তাহলে চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াটি অনেক দূর এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হতো। অন্যদিকে ১৯৯৮ সালে আঞ্চলিক পরিষদ গঠিত হলেও আজ পর্যন্ত এ পরিষদের কার্যপ্রণালি বিধি গঠন করা হয়নি। ফলে আঞ্চলিক পরিষদ যথাযথভাবে তার কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে না। কার্যপ্রণালিবিধি না থাকায় পার্বত্য জেলা পরিষদ ও জেলা প্রশাসনের সঙ্গে আঞ্চলিক পরিষদের কাজের সমন্বয় করা সম্ভব হচ্ছে না। সুনির্দিষ্ট নির্দেশনার অভাবে স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোয় দায়বদ্ধতাও অনুপস্থিত। অসম্পূর্ণ বিধিবিধানের জন্য সব ক্ষেত্রে চুক্তি লঙ্ঘনের মতো ঘটনা ঘটে চলেছে। এসব দুর্বলতা অতিসত্বর দূর করে স্থানীয় শাসনব্যবস্থায় গতিশীলতা ও দায়বদ্ধতা বাড়াতে হবে।
পাঁচ বছর অন্তর পার্বত্য জেলা পরিষদগুলোয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা থাকলেও প্রায় ২০ বছর ধরে এগুলো অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদ দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। ফলে যে সরকার ক্ষমতায় আসে সে সরকারের দলীয় লোকদের দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদ গঠিত হওয়ায় এ প্রতিষ্ঠানগুলো দলীয় প্রভাবমুক্ত হতে পারছে না। পরিষদগুলো মনোনীত ব্যক্তিদের দিয়ে পরিচালিত হওয়ায় দায়িত্বপ্রাপ্তদের জনগণের কাছে কোনো জবাবদিহি নেই। অন্যদিকে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাও এ প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে প্রতিফলিত হচ্ছে না। অথচ জেলা পরিষদ গঠনের মূল উদ্দেশ্যই ছিল, নির্বাচনের মাধ্যমে স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় সব জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা ও সার্বিক উন্নয়ন সাধন করা।
বর্তমানে চুক্তি বাস্তবায়ন অতি জরুরি এ কারণে যে, বিশ্বায়নের যুগে সমাজ, রাজনীতি ও পরিবেশ পরিস্থিতি দ্রুত বদলাচ্ছে। ফলে চুক্তিটি দ্রুত বাস্তবায়ন করা না হলে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে চুক্তি বাস্তবায়ন করতে গেলে চুক্তিটির মৌলিকতা অক্ষুণ্ন থাকবে কি না, সে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে!
তা ছাড়া চুক্তি বাস্তবায়নকে অগ্রাধিকার না দিয়ে যদি পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক রাখার স্বার্থে কেবল সমন্বিত গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনার সিদ্ধান্ত, স্ট্রাটেজিক ম্যানেজমেন্ট ফোরাম গঠন কিংবা পার্বত্য জেলাগুলোর সীমানা পুনর্বিন্যাস, আঞ্চলিক দলগুলোর কর্মকাণ্ড অথবা মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণের নীতি গ্রহন করে পাহাড়ে প্রকৃত শান্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। অতীত অভিজ্ঞতা তাই বলে। তাই সরকারের এ ধরণের কর্মপরিকল্পনা পাহাড়ের মানুষজনকে আবারও উৎকণ্ঠিত করে তুলেছে। পাহাড়ে যেন আর নতুন করে অবিশ্বাসের বিষবাষ্প ছড়িয়ে না পড়ে সেদিকে সরকারের বিশেষ নজর দেওয়া জরুরি।
পরিশেষে বলতে চাই, পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী শান্তি নিশ্চিত করতে হলে আর কালক্ষেপণ না করে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী আগে ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি করে দ্রুত চুক্তি বাস্তবায়ন করা হোক।
ইলিরা দেওয়ান: মানবাধিকারকর্মী।
ilira.dewan@gmail.com


Prothom Alo Feature




                                                           

----------------------------------

courtesy: prothom-alo

No comments:

Post a Comment