Why we want our voice to be heard?

Pages

Saturday, November 27, 2010

আদিবাসী চিম্বুক পাহাড়ে মানবেতর ম্রো জীবন

আদিবাসীচিম্বুক পাহাড়ে মানবেতর ম্রো জীবন বিপ্লব রহমান, চিম্বুক (বান্দরবান) থেকে ফিরে
বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড়ের বিস্তীর্ণ এলাকায় নিরাপত্তা বাহিনীর উচ্ছেদের ফলে সুয়ালক, টংকাবতী ও কালেঙ্গা এলাকার শত শত ম্রো আদিবাসী পরিবার উদ্বাস্তু হয়ে গেছে। ভূমিহীন ও জুম চাষি (পাহাড়ের ঢালে বিশেষ ধরনের চাষাবাদ) এসব আদিবাসী নিজ ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে চিম্বুক সড়কের দুপাশে অস্থায়ী ঘর তুলে কোনোরকমে জীবনযাপন করছে। সরকারের পক্ষ থেকে এখনো তাদের পুনর্বাসন করা হয়নি।
তবে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) কালের কণ্ঠকে জানিয়েছে, চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার লামা-সুয়ালক ও বান্দরবান-কেরানীহাটের সড়কের সংযোগস্থলে হলুদিয়া নামক স্থানে সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ শিবির বা ফায়ারিং রেঞ্জ রয়েছে। ১৯৯১-৯২ সালে ভূমি অধিগ্রহণ ও ক্রয়ের মাধ্যমে প্রায় সাড়ে ১১ হাজার একর জমির ওপর ফায়ারিং রেঞ্জটি স্থাপিত হয়। এ জন্য সমঝোতার ভিত্তিতে বাঙালি ও ম্রো আদিবাসীদের কাছ থেকে যে প্রায় তিন হাজার একর জমি কেনা হয়, তার বেশির ভাগের মালিকই বাঙালি। ফায়ারিং রেঞ্জের জন্য অধিগ্রহণ করা ও কেনা ভূমিতে বসবাসকারীদের অধিকাংশকেই পুনর্বাসিত করা হয়েছে।
সম্প্রতি সরেজমিনে চিম্বুক পাহাড় এলাকার উচ্ছেদ হওয়া ম্রো আদিবাসীদের মানবেতর জীবনের খণ্ডচিত্র দেখা গেছে। তাঁরা কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন, নব্বই দশকে বিস্তীর্ণ পাহাড়ি এলাকা অধিগ্রহণের পর মাঝে মধ্যেই নিরাপত্তা বাহিনী দুর্গম পাহাড়ে উচ্ছেদ অভিযান চালায়। সর্বশেষ ২০০৭ সালে সুয়ালক, টংকাবতী ও কালেঙ্গা এলাকায় ৫৭০টি ম্রো আদিবাসী পরিবারকে উচ্ছেদ
করা হয়। ফলে শত শত আদিবাসী পরিবার ভিটেমাটি ও চাষবাসের জমি হারিয়ে হতদরিদ্রে পরিণত হয়েছে। অধিগ্রহণের ফলে সংকুচিত হয়েছে তাদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন জুমচাষ। এরপরও উচ্ছেদকৃতরা জুমচাষ করেই কোনো রকমে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন। আবার কোনো কোনো আদিবাসী পেশা বদলে পরিণত হয়েছেন দিনমজুরে। নিরাপত্তা বাহিনীর আপত্তির কারণে তাঁদের কয়েক শ বছরের ঐতিহ্য শিকার করাও এখন বন্ধ। অনিশ্চিত জীবনে চিম্বুক পাহাড়ের প্রধান সড়কের দুপাশে ছোট ছোট ঝুপড়ি ঘরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বাস করছেন অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু ম্রো আদিবাসীরা। তাঁদের অস্থায়ী পাড়াগুলোতে বিদ্যুৎ, সুপেয় পানি, স্যানিটেশন, শিক্ষা ও চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থাই নেই। উপরন্তু সব সময়ই তাঁদের আশঙ্কা, নতুন করে উচ্ছেদ হওয়ার।
সুয়ালকের বাসিন্দা রেং রাং ম্রো (৪৫) ভাঙা বাংলায় কালের কণ্ঠের কাছে আক্ষেপ করে বলেন, 'বছর তিনেক আগে ডিসেম্বরের কঠিন শীতের মধ্যে আমাদের ৫৭০টি পরিবারকে দুদিনের নোটিশে উচ্ছেদ করা হয়। এরপর পরিবার-পরিজন নিয়ে আমরা অসহায় অবস্থায় জঙ্গলের মধ্যে দিন কাটাচ্ছি। জমি অধিগ্রহণের ফলে আমাদের জুম চাষও বন্ধ হতে চলেছে।'
তিনি আহাজারি করে বলেন, 'আমাদের পরনে ভালো কাপড় নেই, ঘরে চাল নেই, ছেলেমেয়েরা কেউ স্কুল যায় না। কেউ অসুস্থ হলে স্থানীয় বৈদ্যের ঝাড়-ফুঁকই ভরসা। কোনো রকমে খেয়ে-না খেয়ে আমাদের দিন চলছে।'
টংকাবতী পাহাড়ের ব্রিকফিল পাড়ার বাসিন্দা সিংলক ম্রো (৩০) বলেন, 'সরকার অনেক আগেই আমাদের ঐতিহ্যবাহী শিকারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এখন উচ্ছেদের ফলে জুমচাষও বন্ধ হতে চলেছে। এ অবস্থায় আমরা যাব কোথায়? খাব কী?'
পাবলা হেডম্যান পাড়ার মেন রেই ম্রো (৪০) বলেন, 'আমরা বিভিন্ন সময় জেলা প্রশাসন ও নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে পুনর্বাসনের জন্য আবেদন করেছি। বান্দরবান সদরে এ নিয়ে মিছিল-সমাবেশও হয়েছে। কিন্তু সরকারি-বেসরকারি কেউ-ই আমাদের জন্য কিছু করেনি। উপরন্তু তিন বছর আগে ইঁদুরের ঝাঁক (স্থানীয়ভাবে 'ইঁদুর বন্যা' নামে পরিচিত) জুমের ফসল খেয়ে ফেলার পর অনেক পরিবার একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছে।'
টংকাবতীর পাউসি ম্রো (৫০) বলেন, 'আমাদের পাড়ার ৪৭টি পরিবারকে দুদিনের নোটিশে উচ্ছেদ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০টি পরিবার কোনো রকমে এখনো জুমচাষ করছে। বাকিরা মাটিকাটা, জঙ্গল পরিষ্কার ইত্যাদি দিনমজুরের কাজ করে কোনো রকমে দিন কাটাচ্ছে।'
ম্রো সোস্যাল কাউন্সিলের সভাপতি রাংলাই ম্রো কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বংশ পরম্পরায় শত শত বছর ধরে আমরা বাস করলেও এখনো বন ও পাহাড়ের ওপর আমাদের অধিকার জন্মেনি। এটি খুবই দুঃখের বিষয়। বিভিন্ন সময় নিরাপত্তা বাহিনীর উচ্ছেদের পর এখনো আমাদের পুনর্বাসন করা হয়নি। উপরন্তু আবারও উচ্ছেদ হওয়ার আতঙ্কে ভুগছেন। উচ্ছেদকৃতদের মৌলিক মানবিক চাহিদার কোনোটিই কোনো নিশ্চয়তাও নেই।'
এদিকে গত ২ নভেম্বর বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড়ের পাবলা হেডম্যান পাড়ায় উচ্ছেদকৃত ম্রো আদিবাসীরা এক সমাবেশের আয়োজন করে। এতে পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমা অভিযোগ করে বলেন, নব্বইয়ের দশকে বান্দরবান সদর উপজেলার সুয়ালকে সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের নামে সাড়ে ১১ হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করে ছয় হাজার ম্রো আদিবাসী এবং স্থায়ী বাঙালি বাসিন্দাকে উচ্ছেদ করা হয়। ওই সব আদিবাসী ও বাঙালি এখন মানবেতর জীবনযাপন করছেন। সাবেক গেরিলা নেতা সন্তু লারমা বলেন, উচ্ছেদ হতে হতে আদিবাসীদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। এখন সময় এসেছে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে তোলার।
আইএসপিআরের বক্তব্য
এসব বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) লিখিত বক্তব্যে জানায়, বান্দরবান মিলিটারি প্রশিক্ষণ এলাকাটি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বাস্তব প্রশিক্ষণের জন্য ফায়ারিং রেঞ্জ হিসেবে বিবেচিত। প্রশিক্ষণ এলাকাটি চট্টগ্রাম জেলার সাতকানিয়া উপজেলাধীন লামা-সুয়ালক ও বান্দরবান-কেরানীহাট সড়কের সংযোগস্থলের হলুদিয়া নামক স্থানে অবস্থিত, যা মূলত একটি বাঙালি অধ্যুষিত এলাকা। প্রশিক্ষণ এলাকাটি ১৯৯১-৯২ সালে ভূমি অধিগ্রহণ ও ক্রয়ের মাধ্যমে স্থাপন করা হয়।
আইএসপিআরের বক্তব্যে বলা হয়, ফায়ারিং রেঞ্জ এলাকাটি মোট ১১ হাজার ৪৬৭ দশমিক ৪৮ একর জমির ওপর স্থাপিত হয়। এর মধ্যে সরকারি খাস জমির পরিমাণ ছিল আট হাজার ৬৩৫ দশমিক ২১ একর এবং ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জমির পরিমাণ ছিল দুই হাজার ৮৩২ দশমিক ২৭ একর। প্রশিক্ষণ এলাকাটি স্থাপনের প্রাক্কালে ক্রয়কৃত জমির অধিকাংশেরই মালিক ছিল স্থানীয় বাঙালিরা এবং নূ্যনতম পরিমাণ জমির মালিক ছিল ম্রো সম্প্রদায়ের জনগণ। ১৯৯০ সালে স্থানীয় বাঙালি ও ম্রো সম্প্রদায়ের লোকজনের সঙ্গে সেনা কর্র্তৃপক্ষের সমঝোতার ভিত্তিতে তৎকালীন ভূমিমূল্য অনুসারে সামরিক ভূমি কর্মকর্তা (এমইও), ইস্টার্ন সার্কেল, চট্টগ্রামের মাধ্যমে নগদ অর্থ প্রদানের বিনিময়ে ব্যক্তিগত জমিগুলো কেনা হয়। ফায়ারিং রেঞ্জ স্থাপনের পর থেকে ওই এলাকার ভূমি মালিকানা-সংক্রান্ত কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার জন্ম নেয়নি কিংবা স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে কোনো রকম ক্ষোভ কিংবা অসন্তোষ পরিলক্ষিত হয়নি। বরং সে সময় স্থানীয় বাঙালি ও পাহাড়ি উভয় সম্প্রদায়ের বাসিন্দারা ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভূমি বিক্রি করেছিল। রেঞ্জের জন্য অধিগ্রহণ ও ক্রয়কৃত ভূমিতে বসবাসকারী জনগণের অধিকাংশকেই সুয়ালক, ভাগ্যকুল, আমতলী, গয়ালমালা, হলুদিয়া এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় পুনর্বাসনে সহায়তা করা হয়। তাঁরা পুনর্বাসিত এলাকায় অদ্যাবধি শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করে আসছে। অধিকন্তু ওই এলাকায় ফায়ারিং রেঞ্জটি স্থাপিত হওয়ার কারণে সেখানে ব্যবসা-বাণিজ্য ও কর্মচাঞ্চল্য বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা স্থানীয় জনগণের জীবনমান উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা রাখছে।
এতে আরো বলা হয়, এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের নামে সেনাবাহিনী কর্তৃক সাড়ে ১১ হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করে ছয় হাজার ম্রো সম্প্রদায় ও স্থায়ী বাঙালি বাসিন্দাদের উচ্ছেদের অভিযোগটি অসত্য, মনগড়া ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
আইএসপিআরের লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, এখানে গত ২২ ফেব্রুয়ারি ২০০৭ বান্দরবান-সুয়ালক এলাকার ম্রো সম্প্রদায়ের নেতা রাংলাই ম্রোকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য একটি এসবিবিএল রাইফেল, একটি পিস্তল, ২৩টি একে-৪৭ রাইফেল এবং ১২টি এসবিবিএলের অ্যামুনিশনসহ যৌথ বাহিনী গ্রেপ্তার করে। আটক ব্যক্তি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার মানসে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন আঞ্চলিক সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ করছে এবং সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ম্রো সম্প্রদায়ের জনগণের জমি দখলের অপপ্রচার চালাচ্ছে। বস্তুতপক্ষে জানা যায়, ম্রো সম্প্রদায়ের জনগণ অত্যন্ত নিরীহ প্রকৃতির এবং সেনাবাহিনীকে কখনোই তাঁরা তাঁদের স্বার্থের বিরুদ্ধ শক্তি হিসেবে বিবেচনা করেনি।
এতে বলা হয়, ১৯৯৭ সালে পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পর পার্বত্যাঞ্চলে ধীরে ধীরে শান্তির পথ প্রশস্ত হচ্ছে এবং বহুবিধ উন্নয়ন কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে এহেন অপপ্রচার বিশেষ স্বার্থান্বেষী মহলের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে প্রতীয়মান হয়। এ অপপ্রচার একদিকে যেমন বর্তমান সরকার এবং সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ন করবে, তেমনি পার্বত্যাঞ্চলের কাষ্টার্জিত শান্তি উন্নয়নের ধারাকে বাধাগ্রস্ত করবে।
  -------------------------  courtesy: the daily kaler kantho 

No comments:

Post a Comment