Why we want our voice to be heard?

Pages

Saturday, September 18, 2010

লক্ষাধিক পরিবারের উদ্বাস্তু জীবন অরুণ কর্মকার, হরি কিশোর চাকমা ও সৈকত দেওয়ান

লক্ষাধিক পরিবারের উদ্বাস্তু জীবন

অরুণ কর্মকার, হরি কিশোর চাকমা ও সৈকত দেওয়ান


---------------


খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার চিত্তরঞ্জন চাকমা ১৯৯৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ভারতের শরণার্থী শিবির থেকে দেশে আসেন। কিন্তু তিনি তাঁর ২৯ নম্বর ছোট মেরুং মৌজার বিপিন কার্বারিপাড়ার জমিতে আজ পর্যন্ত পুনর্বাসিত হতে পারেননি। দীঘিনালার কাঁঠালতলী আবাসিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আরও ২৫টি পরিবারের সঙ্গে তাঁর পরিবারও ২০০৭ সাল পর্যন্ত বসবাস করেছে। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তাঁদের নামমাত্র জমি দিয়ে অন্যত্র সরিয়ে দেওয়া হয়।
রাঙামাটির লংগদু উপজেলার নিউটন চাকমা ১১ নম্বর পেতান্নেমাছড়া মৌজার হেডম্যান। ১৯৮৯ সালে উদ্বাস্তু হয়ে এখন পর্যন্ত তিনি আর নিজের বাড়িতে ফিরতে পারেননি। সারা জীবন বিভিন্ন স্থানে বসবাস করার পর এখন পেতান্নেমাছড়া থেকে সাত কিলোমিটার দূরে বড় আদামে বাড়ি ভাড়া করে তিনি বসবাস করছেন।
মো. আবদুল মান্নানের বাড়ি ছিল ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলায়। ১৯৮১ সালে তাঁর পরিবারকে পুনর্বাসিত (সেটেলার) হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামে নেওয়া হয়। তিনবার জায়গা বদল করে এখন তাঁর বসবাস রাঙামাটির সুবলং ইউনিয়নের বিলছড়া গ্রামের নতুনপাড়ায়। সেখানে আরও কয়েকটি পুনর্বাসিত পরিবারের বসবাস। কিন্তু এসব পরিবার যেখানে বসবাস করছে কিংবা যে জমি ভোগদখল করছে, এর কোনো কাগজপত্র তাদের কাছে নেই।
ছন্নছাড়া জীবন: ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী, অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু ও পুনর্বাসিত বাঙালিদের এ রকম লক্ষাধিক পরিবারের ছন্নছাড়া জীবন। এর মধ্যে প্রায় ৯৩ হাজার আদিবাসী পরিবার, যারা পুনর্বাসনের অপেক্ষায়। এদের প্রায় ৯০ হাজার পরিবার অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু, অন্যরা ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী। আর পুনর্বাসিত বাঙালি পরিবার যে কত, তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। একসময় এরা গুচ্ছগ্রামে থাকত। কিন্তু প্রজন্মের পর প্রজন্ম তো গুচ্ছগ্রামের বদ্ধ জীবন মানুষকে বেঁধে রাখতে পারে না। তাই তাদের অনেকেই বের হয়ে পড়েছে। বাধ্য হয়ে বেছে নিয়েছে ছন্নছাড়া জীবন।
সরকারি সূত্র জানায়, আগের আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে (১৯৯৬-২০০০) গঠিত ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পুনর্বাসনবিষয়ক টাস্কফোর্স তিনটি পার্বত্য জেলায় মোট ৯০ হাজার ২০৮টি আদিবাসী পরিবারকে অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু হিসেবে চিহ্নিত করেছিল।
২০০০ সালের ১৫ মে টাস্কফোর্সের তৎকালীন চেয়ারম্যান এবং বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের জেলাভিত্তিক পরিবারের সংখ্যা ঘোষণা করেন। সে অনুযায়ী রাঙামাটিতে ৩৫ হাজার ৫৯৫, বান্দরবানে আট হাজার ৪৩ এবং খাগড়াছড়িতে ৪৬ হাজার ৫৭০টি পরিবার রয়েছে। এদের একটি পরিবারও পুনর্বাসিত হয়নি।
এ ছাড়া ভারত থেকে ফিরে আসা আদিবাসী শরণার্থী পরিবার ছিল ১২ হাজার ২২২টি। এর মধ্যে নয় হাজারের মতো পুনর্বাসিত হয়েছে। বাকি তিন হাজরেরও বেশি পরিবার এখনো উদ্বাস্তুর মতো ছন্নছাড়া জীবন যাপন করছে।
টাস্কফোর্সের কার্যক্রম: বর্তমান সরকার গত বছরের ২৩ মার্চ খাগড়াছড়ির সাংসদ যতীন্দ্রলাল ত্রিপুরাকে চেয়ারম্যান করে টাস্কফোর্স পুনর্গঠন করে। এটি চতুর্থ টাস্কফোর্স। গত বছরের ৫ অক্টোবর খাগড়াছড়ি সার্কিট হাউসে টাস্কফোর্সের সভায় অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পরিবারগুলোর আগের তালিকা প্রকাশ করা হয়। সিদ্ধান্ত হয় পরবর্তী সভা থেকে উদ্বাস্তুদের তালিকা যাচাই-বাছাই করে পুনর্বাসনের কাজ শুরু করার। প্রতি মাসে সভা করার বিধান থাকলেও তা হয় না। টাস্কফোর্সের সর্বশেষ সভা হয় গত জানুয়ারিতে। সেখানেও কাজের বিশেষ কোনো অগ্রগতি হয়নি। তারপর আর কোনো সভাই হয়নি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে যতীন্দ্রলাল ত্রিপুরা প্রথম আলোকে বলেন, শিগগিরই টাস্কফোর্সের সভা হবে। আর অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের ব্যাপারে সরকারের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্ত দরকার।
শরণার্থী-উদ্বাস্তুদের অভিযোগ: অমরেন্দ্র চাকমা (৬২), পিতা সূর্য সেন চাকমা একজন প্রত্যাগত শরণার্থী। ঠিকানা ছিল রসিক নাগরপাড়া, দীঘিনালা, খাগড়াছড়ি। ১৯৯৮ সালে দেশে ফিরে এলেও এখন পর্যন্ত ভিটেমাটি ফেরত পাননি। বর্তমানে খাগড়াছড়ির রত্নমোহন মেম্বারপাড়ায় অন্যের জায়গায় বসবাস করছেন। একটি মুদি দোকানের পসরা বসিয়ে সংসার চালাচ্ছেন। তিনি বলেন, সরকার রেশন বন্ধ করে দিলে তাঁদের আর কোনো উপায় থাকবে না।
সুরনাথ চাকমা (৬৫), পিতা মৃত সুধন্য চাকমাও প্রত্যাগত শরণার্থী। ঠিকানা ছিল রসিক নাগরপাড়া, দীঘিনালা, খাগড়াছড়ি। নিজের ভিটেমাটি ফেরত পাননি। বর্তমানে রত্নমোহন মেম্বারপাড়ার ইন্দ্রমোহন চাকমার জায়গায় অস্থায়ী বসবাস। তিনি বলেন, ইন্দ্রমোহন চাকমা জায়গা ছেড়ে দিতে বললে পথে আশ্রয় নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।
সুবর্ণা চাকমার পরিবার ১৯৭৯ সালে লংগদু উপজেলার বগাতচর ইউনিয়নের ৯ নম্বর মারিশ্যাচর মৌজার উদয়ছড়া গ্রামের নিজস্ব ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হন। এরপর নানা স্থান ঘুরে এখন আছেন রাঙামাটি শহরের পর্যটন এলাকার একটি বাড়িতে পাহারাদার হিসেবে।
বিপুলেশ্বর চাকমা (৫৩), পিতা মৃত বীর সেন চাকমা অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু। ঠিকানা ছিল ছোট মেরুং, দীঘিনালা, খাগড়াছড়ি। সেখান থেকে উচ্ছেদ হয়ে অনেক জায়গা ঘুরে এখন থাকছেন দীঘিনালার কালাচান মহাজনপাড়ায়। তিনি বলেন, এখনো তাঁদের পরিবারের নামে বন্দোবস্তকৃত ভূমির খাজনা হেডম্যানকে নিয়মিত দিয়ে আসছেন। তাঁদের জায়গা-জমি দখল করে আছেন করিম মেম্বার, মালেক মিস্ত্রিসহ কয়েকজন পুনর্বাসিত বাঙালি।
নন্দী বালা (৬২), স্বামী মৃত দিতেশ্বর দেওয়ান। তিনিও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু। ঠিকানা ছিল কালাচান মহাজনপাড়া, দীঘিনালা, খাগড়াছড়ি। তিনি বলেন, ১৯৮৬ সালে পুনর্বাসিত বাঙালিদের হামলার শিকার হয়ে ভারতে আশ্রয় নিলেও ১৯৯১ সালে স্বেচ্ছায় দেশে ফিরে আসায় প্রত্যাগত শরণার্থী হিসেবে বিবেচিত হননি। কোনো সরকারি সুযোগ-সুবিধাও পাননি। সেটেলার রেজাউল চেয়ারম্যানসহ কয়েকজন তাঁর জমি দখল করে আছেন বলে অভিযোগ করে তিনি বলেন, মামলা করে ১৯৯৪ সালে জমির মালিকানা পেয়ে কিছু জমি দখলে নেন। রেজাউল চেয়ারম্যান ও অন্যরা পাল্টা মামলা করে বাকি জমির দখল পেতে বাধা সৃষ্টি করেছেন।
কল্যাণ সমিতির অভিযোগ: জুম্ম শরণার্থী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক সন্তোষিত চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, অধিকাংশ প্রত্যাগত শরণার্থী পরিবার অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা পেলেও জমি ও ভিটেমাটি পায়নি। নয় হাজার ৭৮০টি পরিবার পরিপূর্ণভাবে তাদের ধানি জমি, বাগান ও বসতভিটা ফেরত পায়নি। ৮৯০টি পরিবার হালের গরুর টাকা পায়নি। স্থানান্তরিত ছয়টি বিদ্যালয় আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনা হয়নি। স্থানান্তরিত পাঁচটি বাজার পুনঃস্থাপন হয়নি। ৬৪২ জন শরণার্থীর ঋণ মওকুফ করা হয়নি। ৪০টি গ্রাম ও সাতটি হিন্দু-বৌদ্ধ মন্দির পুনর্বাসিত বাঙালিদের দখলে রয়েছে। প্রত্যাগত শরণার্থীরা বেশ কয়েকটি সাম্প্রদায়িক হামলার শিকার হয়েছে। এ ছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে অনেক জমি বেদখলের ঘটনা ঘটেছে।
আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেএসএসের সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমা প্রথম আলোকে বলেন, এসব বিষয় মীমাংসার জন্য অবিলম্বে টাস্কফোর্সের বৈঠক করে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার বলেন, এসব সমস্যা ভূমিকেন্দ্রিক। ভূমি কমিশনকে কার্যকর করেই এসব সমস্যার সমাধান করতে হবে। সরকার সেই চেষ্টা করছে।
নাগরিক কমিটির সহায়ক কর্মসূচি: পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের সহায়ক কর্মসূচি নিয়ে সক্রিয় হয়েছে সম্প্রতি গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটি। আদিবাসী জনগোষ্ঠী ও তাদের অধিকারের সাংবিধানিক স্বীকৃতিসহ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কার্যক্রম পরিচালনা এই কমিটির প্রধান কাজ।
গৌতম দেওয়ানকে চেয়ারপারসন ও যশেশ্বর চাকমাকে সেক্রেটারি করে গঠিত নয় সদস্যের এই কমিটি (মোট ১৫ সদস্যের হবে) ইতিমধ্যে ওই অঞ্চলে স্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় সরকার ও সমাজের অন্যান্য অংশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ, আলোচনা, মতবিনিময় প্রভৃতি কার্যক্রম শুরু করেছে।
কমিটি পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে প্রথমত সহনশীল সহাবস্থান এবং পর্যায়ক্রমে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান পৌঁছে দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, নাগরিক কমিটির প্রতিনিধিদের সঙ্গে জনসংহতি সমিতি, ইউপিডিএফ ও জেএসএস (বিক্ষুব্ধ) নেতাদের এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
ভূমি কমিশনের কাজকর্ম সম্পর্কে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উদ্বেগ জানিয়ে এবং এ ব্যাপারে প্রতিকার পাওয়ার লক্ষ্যে কমিটি সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একটি স্মারকলিপি পাঠিয়েছে। এতে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিদ্যমান সার্বিক পরিস্থিতি বর্ণনা করে ভূমি কমিশনের চুক্তিবিরোধী কাজে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। কমিটি অবিলম্বে ভূমি কমিশন আইন সংশোধন এবং ওই আইন প্রয়োগের বিধিমালা প্রণয়ন করে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অনুযায়ী ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির দাবি জানিয়েছে।
এ ছাড়া নাগরিক কমিটি পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের পাশাপাশি আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতীয় পর্যায়ে রাজনীতিবিদ, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক সংসদীয় ককাস, আইনজ্ঞ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ, মতবিনিময় প্রভৃতি চালিয়ে যাচ্ছে। সংবিধান সংশোধনের জন্য গঠিত বিশেষ কমিটির কাছে উপস্থাপনের জন্য নাগরিক কমিটি আদিবাসীদের পক্ষ থেকে একটি প্রস্তাব প্রণয়ন করছে বলেও জানা গেছে।
গৌতম দেওয়ান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় কমিটি গঠনের লক্ষ্যে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থানীয় শাসনব্যবস্থার সমন্বয়হীনতা দূর করতে তাঁরা কাজ করছেন। প্রায় অকার্যকর জেলা পরিষদকে কার্যকর করতে জেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠান যে জরুরি, সে কথাও তাঁরা জাতীয় নেতাদের কাছে তুলে ধরছেন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন সম্পর্কে পার্বত্যবাসীর হতাশাব্যঞ্জক মনোভাব, আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ক্রমাগত হানাহানি, নির্বিচার চাঁদাবাজি, ভূমি জরিপ নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কিত পরিস্থিতি প্রভৃতি মিলে সেখানকার বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সক্রিয় নাগরিক কমিটির প্রতি সর্বস্তরের মানুষের ইতিবাচক মনোভাব লক্ষ করা গেছে। (শেষ)

No comments:

Post a Comment