ভূমি জরিপ নিয়ে তীব্র বিরোধ
অরুণ কর্মকার ও হরি কিশোর চাকমাসরকার ভূমি কমিশন আইনের অসামঞ্জস্যগুলো দূর করার যথাযথ পদক্ষেপ না নেওয়ায় এবং বিরোধ নিষ্পত্তির আগে ভূমি জরিপের ব্যাপারে কমিশনের চেয়ারম্যানের অনড় অবস্থান পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি জটিলতর করে তুলেছে। এই জটিলতা পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়ন এবং সেখানকার ভূমি সমস্যার সমাধান নিশ্চিতভাবে বিলম্বিত করবে। এ ছাড়া বিষয়টি ওই অঞ্চলে আরও অনেক নতুন জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে।
ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি করে প্রত্যাগত শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের আগে জরিপের উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে আমাদের সবচেয়ে বড় কাজ হলো ভূমির সমস্যা নিরসন করা। ভূমি সমস্যার সমাধান করার জন্য আমরা ভূমি কমিশন করেছি। ভূমি কমিশন আইন যদি সংশোধনের প্রয়োজন হয়, নিশ্চয়ই সেটা করা হবে। তবে তার আগে ভূমি কমিশনকে সহযোগিতা করতে হবে।’
প্রতিমন্ত্রী বলেন, ২২ সেপ্টেম্বর ভূমি কমিশন আইন সংশোধনের বিষয়ে সভা হবে। সেখানে সংশ্লিষ্ট অন্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদেরও ডাকা হয়েছে। তাঁরা সমস্যার সমাধান চান। তিনি বলেন, জরিপ আগে হোক বা পরে হোক, তা করতে হবে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির আলোকেই।
সমস্যার মূলে কী: ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকার ও জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) মধ্যে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ‘ঘ’ খণ্ডের ২ ধারায় বলা হয়েছে, ‘...উপজাতীয় শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ উপজাতীয় উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের পর সরকার চুক্তি অনুযায়ী গঠিত আঞ্চলিক পরিষদের সঙ্গে আলোচনাক্রমে যথাশীঘ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি জরিপ কাজ শুরু এবং যথাযথ যাচাইয়ের মাধ্যমে জায়গা-জমিসংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তিকরত উপজাতীয় জনগণের ভূমি মালিকানা চূড়ান্ত করিয়া তাহাদের ভূমি রেকর্ডভুক্ত ও ভূমির অধিকার নিশ্চিত করিবেন।’
অপরদিকে ২০০১ সালে জাতীয় সংসদে প্রণীত পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনে বিরোধ নিষ্পত্তির পূর্ণ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে কমিশনকে। ভূমি কমিশন আইনের ৬(৩) ধারা অনুযায়ী কমিশন ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে সরকারের কাছে ওই অঞ্চলের ভূমি জরিপ প্রতিবেদন চাইতে তথা জরিপ করার সুপারিশ করতে পারে। পাশাপাশি ভূমি কমিশন আইনের ৯ ধারা অনুযায়ী কমিশন ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি মালিকদের কাছ থেকে আবেদনপত্রও চাইতে পারে। বর্তমান ভূমি কমিশন এ দুটি পদক্ষেপই নিয়েছে।
ভূমি কমিশনের সূত্র প্রথম আলোকে বলেছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের সঙ্গে ভূমি কমিশনের কোনো সম্পর্ক নেই। চুক্তি বাস্তবায়নের কাজ সরকারের। আর কমিশনের কাজ হচ্ছে তার জন্য বিশেষভাবে প্রণীত আইনের আওতায় কাজ করা। আইনে যদি কোনো ত্রুটি বা অসামঞ্জস্য থাকে, সেটাও নিরসনের দায়িত্ব সরকারের। সরকার বিদ্যমান আইন সংশোধন করলে কমিশনও ওই সংশোধিত আইন অনুযায়ী কাজ করতে বাধ্য।
আর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বিধান (‘ঘ’ খণ্ডের ২ ধারা) এবং ভূমি কমিশন আইনের (৬/৩ ও ৯ ধারা) মধ্যে যে অসামঞ্জস্য, সেটাই বিরোধের মূল। সরকার ২০০১ সালে ভূমি কমিশন আইন পাস করে। এর পরই জনসংহতি সমিতি চুক্তি ও আইনের অসামঞ্জস্যগুলো দূর করতে সংশোধনী প্রস্তাব দেয়। সে অনুযায়ী যথাসময়ে আইন সংশোধন হলে আজকের এই বিরোধপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে।
প্রসঙ্গত, পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের পর এর আগে তিনবার ভূমি কমিশন গঠন করা হয়। কিন্তু আইনি জটিলতার কারণে একটি কমিশনও ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির কাজ শুরুই করতে পারেনি। এবারও বিরোধ নিষ্পত্তির আগে জরিপের প্রসঙ্গ আসায় কাজটি অনিশ্চিত হয়ে পড়ল বলে সংশ্লিষ্ট অনেকেরই ধারণা। কারণ জরিপ একটি সময়সাপেক্ষ, জটিল ও ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া।
কমিশনের চেয়ারম্যান কী বলেন: পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি খাদেমুল ইসলাম চৌধুরী এই বিরোধ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ভূমি কমিশন আইনে জরিপ আগে না পরে—এ রকম কিছু বলা নেই। বলা আছে, কমিশন জরিপ প্রতিবেদন চাইতে পারে। সে অনুযায়ী আমরা জরিপ করতে বলেছি। কারণ আমরা ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির হাতে তাঁর জমি বুঝিয়ে দিতে চাই। কাজেই বিরোধ নিষ্পত্তির প্রক্রিয়া শুরু করতে করতে যদি জরিপের কাজটা এগোয়, তাহলে সুবিধা হয়।’
কিন্তু জরিপকারীরা যদি কাউকে মালিক হিসেবে নির্ধারণ করেন আর সেই ব্যক্তি যদি প্রকৃত মালিক না হন, তাহলে তো প্রকৃত মালিক বঞ্চিত হতে পারেন। সে ক্ষেত্রে কী হবে? এই প্রশ্নের জবাবে কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, জরিপ অধিদপ্তরের মালিকানা নির্ধারণের একটা আইনি ক্ষমতা আছে। কিন্তু সেটা ভূমি কমিশনের ওপর বর্তায় না। কমিশন মালিকানা ঠিক করবে তার আইন ও বিচার অনুযায়ী। কাজেই জরিপকারীরা একজনকে মালিক বললেই তিনি মালিক হয়ে যাবেন না। তা ছাড়া কমিশন শুধু জরিপই করবে না, পাশাপাশি ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে আবেদন নিয়ে তা শুনানির জন্যও তৈরি করছে।
চেয়ারম্যান জানান, এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে চার হাজার আবেদন কমিশনের কাছে জমা পড়েছে। প্রায় এক হাজার আবেদন শুনানির জন্য তৈরি হয়ে গেছে। শুনানির মাধ্যমে নিষ্পত্তি করে প্রকৃত মালিককে যেন নির্দিষ্ট জমি বুঝিয়ে দেওয়া যায়, সে জন্যই জরিপটা দরকার। চুক্তির সঙ্গে ভূমি কমিশন আইনের অসামঞ্জস্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটি সরকারের বিষয়, কমিশনের নয়।
এ প্রসঙ্গে চাকমা রাজা দেবাশীষ রায় প্রথম আলোকে বলেন, ভূমি জরিপের অজুহাতে কমিশনের কাজ অর্থাৎ পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি বন্ধ রাখা বা বিলম্বিত করা হবে দুঃখজনক। ভূমি কমিশন আইন দ্রুত সংশোধন করে বিরোধ নিষ্পত্তির কাজ শুরু করা প্রয়োজন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান বলেন, জরিপের সঙ্গে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির কোনো সম্পর্ক নেই। বিরোধ নিষ্পত্তি করতে হবে পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী। সেটা না করে জরিপের উদ্যোগ পার্বত্য চট্টগ্রামে বিরোধ বাড়াবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল জেএসএস, ইউপিডিএফ, জেএসএস (বিক্ষুব্ধ) চায় চুক্তি অনুযায়ী আগে শরণার্থী ও উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন। এদের মধ্যে অনেকে মনে করে, ভূমি কমিশন চুক্তির বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে। এই অবস্থানের জন্য জেএসএসের (বিক্ষুব্ধ) ভাইস চেয়ারম্যান রূপায়ণ দেওয়ান ভূমি কমিশন চেয়ারম্যানের অব্যাহতি দাবি করছেন।
সরকার কী করছে: সম্প্রতি ভূমি মন্ত্রণালয় ভূমি কমিশন আইনের ছয়টি ধারা সংশোধনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আগে আলোচনার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি সর্কেলের প্রধান (তিন রাজা) ও আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান সন্তু লারমাসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে ২২ সেপ্টেম্বর মন্ত্রণালয় বৈঠকে বসবে বলে জানা গেছে।
আবার ভূমি মন্ত্রণালয় যে ধারাগুলো সংশোধনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাকে অপূর্ণাঙ্গ বলছে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো। ভূমি কমিশনের সদস্য রাজা দেবাশীষ রায় বলেছেন, আরও অন্তত তিনটি ধারা সংশোধন করা অত্যাবশ্যক। এগুলো হচ্ছে এক. কমিশন চেয়ারম্যানের নিরঙ্কুশ ক্ষমতার বিধান রহিত করা; কমিশনের সভায় কোনো বিষয়ে একমত না হলে সে বিষয়ে চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত—এই ধারা পরিবর্তন করা। দুই. চেয়ারম্যানসহ কমিশনের তিন সদস্য উপস্থিত থাকলেই কোরাম হওয়ার বিধান পরিবর্তন করা; তা না হলে চেয়ারম্যান ও দুজন সরকারি সদস্য—চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার বা অতিরিক্ত কমিশনার এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের সংশ্লিষ্ট জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সভায় উপস্থিত থাকলেই কোরাম হয়। তিন রাজা ও আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যানদের একজনও উপস্থিত না থাকলেও সভা যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কাজেই কমিশনের সভায় কোরাম হওয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট রাজা বা প্রতিনিধি, আঞ্চলিক পরিষদের চেয়াম্যান ও সংশ্লিষ্ট জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের উপস্থিতি আবশ্যকীয় করতে হবে। তিন. কমিশনের সভায় তিন রাজার প্রতিনিধি পাঠানোর বিধান করতে হবে। কারণ চাকমা রাজা জাতিসংঘের আদিবাসীবিষয়ক কমিটিসহ আন্তর্জাতিক অনেক সংস্থার সদস্য। তাঁকে এসব কাজে প্রায়ই দেশের বাইরে থাকতে হয়। বোমাং রাজা দীর্ঘদিন ধরে গুরুতর অসুস্থ ও শয্যাশায়ী। তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে সব কাজ পরিচালনা করেন তাঁর ছেলে। বর্তমান মং রাজা (উত্তরাধিকার সূত্রে নির্বাচিত) কলেজের ছাত্র। জমিজমার বিষয়ে অভিজ্ঞতা কম। কাজেই ভূমি কমিশনের সভায় বিভাগীয় কমিশনার ও আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যানের মতো এই তিন রাজারও প্রতিনিধি পাঠানোর বিধান করা জরুরি।
অবিরোধীয় ভূমি জরিপ: তিন পার্বত্য জেলার যেসব ভূমি নিয়ে বিরোধ নেই, সরকার সেই অবিরোধীয় ভূমি জরিপের উদ্যোগ নিয়েছে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ভূমি জরিপ অধিদপ্তরকে নির্দেশও দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে রাজা দেবাশীষ রায় বলেন, অবিরোধীয় ভূমি জরিপ কেন প্রয়োজন, এর উদ্দেশ্য কী, তাঁর কাছে তা স্পষ্ট নয়। নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান বলেন, অবিরোধীয় ভূমি জরিপ সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক।
পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির সঙ্গে ভূমি জরিপের বিষয়টি একীভূত করা ঠিক নয়। ভূমি জরিপ অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ, জটিল ও ব্যয়বহুল কাজ। তাই বিরোধ নিষ্পত্তি জরিপনির্ভর হলে তা অনির্দিষ্টকালের জন্য বিলম্বিত হবে।
সূত্র জানায়, জরিপের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট জমির ভৌগোলিক বিবরণ, আয়তন, সীমানা ও দখলদারের পরিচয় জানা যাবে। কিন্তু ওই জমির ওপর প্রথাগত আইনসহ অন্যান্য আইনভিত্তিক স্বত্বের তথ্য জানা যাবে না। প্রথাগত আইনের বিষয়ে বিশদ আলোচনা ও তথ্য সংগ্রহ ছাড়া ভূমি কমিশন তার কাজ যথাযথভাবে করতে পারবে না।
জরিপের মাধ্যমে অনেক ক্ষেত্রে জমির অবৈধ দখলদারের স্বত্বেরও স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কাজেই দখলে নেই অথচ বৈধ স্বত্ব আছে, এমন ব্যক্তির ভূমি জরিপের ব্যাপারে সন্দেহ থাকাই স্বাভাবিক।
---------------------
source: the daily prothom alo (17.09.2010)
No comments:
Post a Comment