আদিবাসীদেরকে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বানানোর সরকারী প্রচেষ্টা অযৌক্তিক
April 30, 2011বাংলাদেশের সংবিধানে আদিবাসীদেরকে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি না দিয়ে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী-হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করার সরকারী প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। বর্তমান সময়ে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে আদিবাসীদেরকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে, কিন্তু সরকার সংবিধানে আদিবাসী হিসেবে উল্লেখ না করে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী হিসেবে উল্লেখ করার প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে আদিবাসীদের সাথে প্রতারনা করছে। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের উদ্যোগে গতকাল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী নয়, আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবীতে বিশাল গণসমাবেশে বক্তারা এ অভিযোগ করেন।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি শ্রী জ্যোতিরিন্দ্রি বোধিপ্রিয় লারমা সন্তু লারমা’র সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য, অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন ছিদ্দিক, বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক আনিসুর রহমান মল্লিক, আইন ও সালিশ কেন্দ্র এর নির্বাহী পরিচালক এডভোকেট সুলতানা কামাল, গণফোরামের প্রেসিডিয়াম সদস্য পঙ্কজ ভট্টাচার্য, বিশিষ্ট কলামিষ্ট ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ, কর্মজীবী নারীর সমন্বয়ক ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের শিরিন আক্তার, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাসগুপ্ত, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের কেন্দ্রীয় সদস্য শুভ্রাংশু চক্রবর্তী, বাংলাদেশ আদিবাসী অধিকার আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক মেসবাহ কামাল, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রবীন্দ্রনাথ সরেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির তথ্য ও প্রচার সম্পাদক মঙ্গল কুমার চাকমা, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সদস্য নেরলা তংসং, একশন-এইড-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবীর, অক্সফাম-জিবি-এ প্রোগাম ম্যানেজার এম বি আক্তার, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের ডা. শামীম ইমাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এইচ কে এস আরেফিন, অন্য পক্ষ এর সম্পাদক মাসুদা ভাট্টি, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাংগঠনিক সম্পাদক শক্তিপদ ত্রিপুরা, এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী রোজালিন কষ্টা, বাগেরহাট আদিবাসী প্রতিনিধি সুশীল বাগদী প্রমুখ। স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং এবং পরিচালনা করেন কাপেং ফাউন্ডেশনের ভাইস চেয়ারপার্সন দীপায়ন খীসা।
সমাবেশে বক্তাগণ বলেন, দেশের অনেক আইনে, সরকারী পরিপত্র ও দলিলে এবং আদালতের রায়ে এ দেশের বিভিন্ন জাতিসমূহকে আদিবাসী বা তার সমার্থক গোষ্ঠী হিসেবে উলেখ করা হয়েছে। যেমন- পূর্ববঙ্গ রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫০ আইনে aboriginal castes and tribes শব্দ ব্যবহৃত হয়। ১৯৯৫ সালের অর্থ আইন indigenous hillmen বা আদিবাসী গিরিবাসী শব্দ ব্যবহার করে পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের আয়কর প্রদান থেকে অব্যহতি দেয়ার বিশেষ প্রবিধান রেখেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন, ১৯০০ (১৯০০ সালের ১নং রেগুলেশন) আইনে indigenous tribes এবং indigenous hillman শব্দ ব্যবহৃত হয়। শুধু তাই নয়, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বয়ং ২০০০ ও ২০০৯ সালে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম কর্তৃক প্রকাশিত সংহতি সংকলনে প্রদত্ত বাণীতে এসব জাতিসমূহকে আদিবাসী হিসেবে উলেখ করেছিলেন। এছাড়া মহাজোটের ২৩ দফা দাবীনামা, বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র, ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহার ও ২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় কাউন্সিল কর্তৃক গৃহীত ঘোষণাপত্র ও কর্মসূচীতে সুস্পষ্টভাবে আদিবাসী শব্দটি উলেখ রয়েছে।
বক্তারা আরো বলেন, আদিবাসী শব্দের অর্থ নিয়ে অন্যরকম ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। আদিবাসী অর্থ তো কে কোথায় প্রথম আবির্ভূত হলো বা বসতি গড়ে তুললো তা একমাত্র বিষয় নয়। আদিবাসী বলা হলে অন্যরা অ-আদিবাসী বা বহিরাগত হয়ে যাবে, এমন কোন বিষয় নয়। আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের সময় থেকে ঐতিহাসিক কারণে এই আদিবাসীরা বঞ্চিত ও শোষিত। আমাদের দেশেও আদিবাসী মানেই নিজবাসভূমে পরবাসী একশ্রেণীর অসহায় মানুষ যাদের জায়গা-জমি, পাহাড়-বন, আবাসস্থল শক্তির জোরে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। যাদের একসময় ভাষা ও সংস্কৃতি ছিল, এখন বিপন্ন। প্রসঙ্গত ইহা প্রণিধানযোগ্য যে, জাতিসংঘ আদিবাসী বা ইনডিজিনাস পিপলস্ শব্দের কোনো সংজ্ঞা দেয়নি, কারণ আদিবাসীরা আন্তর্জাতিকভাবে এটি চায়নি। এর মূল কারণ হলো, আদিবাসীদের আত্ম-পরিচয়ের অধিকার। নিজেদের পরিচয় নিজেরাই নির্ধারণ করবে এটাই ছিল আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মূলনীতি। তাই আদিবাসী জাতিসমূহ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী হিসেবে নয়, আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি চায়।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি শ্রী জ্যোতিরিন্দ্রি বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) বলেন, বাংলাদেশের জন্ম লাভের পর যখন প্রথম সংবিধান লিখিত হয় তখন আদিবাসীদের নেতা মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা সেই সংবিধানে আদিবাসীদের মৌলিক অধিকার স্বীকৃতি দানের দাবি জানিয়ে ছিলেন। কিন্তু তার সেই দাবি পূরণ করা হয়নিভ যদি পূরণ করা হত তাহলে আজ আদিবাসীদেরকে এই দাবি জানাতে হত না।
তিনি আরো বলেন, আজও আদিবাসীরা বিভিন্নভাবে নির্যাতন নিপীড়নের শিকার। তারা এদেশে তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিকের মত বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছে। কারণ তারা বাংলাদেশের সংবিধানে আজ পর্যন্ত স্বীকৃতি পায়নি। তিনি বলেন, বর্তমানে সংবিধানে আদিবাসীদের স্বীকৃতি দেওয়ার একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে, কিন্তু সরকার আদিবাসীদেরকে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী হিসেবে আখ্যায়িত করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে। তিনি আরো বলেন, আদিবাসীদের উপর জোর করে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পরিচিতি চাপিয়ে দেয়া আদিবাসীদের মানবাধিকারের লঙ্ঘন। তিনি সরকারকে হুশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেন, আদিবাসীদেরকে আদিবাসী হিসেবেই স্বীকৃতি দিতে হবে।
এডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, এতদিন আমরা সকলে আদিবাসীদেরকে আদিবাসী হিসেবেই চিনে এসেছি। কিন্তু এখন হঠাৎ করে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করার বিষয়টি গ্রহণযোগ্য নয়। সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিলে আদিবাসী হিসেবেই দেওয়া উচিত। আদিবাসীরা নিজেদের পরিচয় নিজেরাই নির্ধারণ করবে। কিন্তু সরকার যদি তাদের পরিচয় চাপিয়ে দেয় তা কখনো গ্রহণযোগ্য নয়।
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, এ দেশের বাঙালিদের যদি অধিকার থাকে তাহলে আদিবাসীদেরও অধিকার রয়েছে। এটা শুধু বাঙালির রাষ্ট্র নয়, আরো অনেক জাতির রাষ্ট্র। আদিবাসী বলতে কি বোঝায় আর ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বলতে কি বোঝায় তা আমাদের জানা আছে। অন্য জাতিগোষ্ঠীকে দলন-পীড়নের জন্য আমরা এমন দেশ চাইনি। তিনি আদিবাসীদের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের দাবী জানান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন ছিদ্দিক বলেন, এটা গণতান্ত্রিক সরকার। এ সরকার আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তিনি আদিবাসীদের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতির দাবীর সাথে সংহতি প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, শিক্ষা ছাড়া অগ্রগতি সম্ভব নয়। তিনি শিক্ষার উপর জোর দিতে আদিবাসীদের প্রতি আহ্বান জানান। শিক্ষানীতিতে আদিবাসীদের মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা প্রচলনের বিধান রয়েছে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটার বাইরেও মেধা ভিত্তিতে আদিবাসী ছাত্রছাত্রীদের ভর্তির ব্যবস্থা করে দেন বলে জানান।
পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, পার্বত্য এলাকার মত সমতলের আদিবাসীদের জন্যও ভূমি কমিশন করতে হবে। আদিবাসীদের আন্দোলন সকলের আন্দোলন, এটা মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। যারা এই আন্দোলন সংগ্রাম মানেনা তারা স্বৈরাচারী। আদিবাসীদের পরিচয় অন্য কাউকে ঠিক করে দিতে হবে কেন? যদি আদিবাসীদের স্বীকৃতি দেওয়া না হয়, তাহলে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশ হবে না।
মঙ্গলকুমার চাকমা বলেন, কোন জাতির পরিচয় অন্য কোন জাতি দিতে পারেন। যদি সেটা করা হয় তাহলে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়। দীর্ঘ ৪০ বছর পর আজ আদিবাসীদের সুযোগ এসেছে। জাতিগত পরিচিতির স্বীকৃতির পাশাপাশি আদিবাসীদের মৌলিক মানবাধিকার অধিকার, সংস্কৃতি, বিশেষ বা স্বশাসন, অংশগ্রহণ ও প্রতিনিধিত্ব, বন-ভূমি-প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকারের স্বীকৃতি দিতে হবে।
এড.রানা দাসগুপ্ত বলেন, শুধু পাহাড়ের আদিবাসী নয়, সমতলের আদিবাসীরাও ৬০ বছর ধরে ভূমি সমস্যার সাথে, তাদের ভূমি বেদখলের সাথে বসবাস করছে। এসব সমস্যার সমাধান হতে হবে এবং যথাযথ অধিকার প্রতিষ্ঠা পেতে হবে।
রবীন্দ্রনাথ সরেন বলেন, বাংলাদেশের আদিবাসীরা রাষ্ট্রের বিভিন্ন সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এটা আদিবাসীদের কাম্য নয়। সংবিধানে আদিবাসী হিসেবে অন্তর্ভূক্তির জন্য আমরা আবেদন জানাচ্ছি। গণ আন্দোলন কখনোই বৃথা যায়না। যারা লাঞ্ছিত হচ্ছে, তারা এখন লড়াই করছে। এ লড়াই কোনদিন বৃথা যাবেনা।
শুভ্রাংশু চক্রবর্তী বলেন, দেশের সকল আদিবাসীর সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি জানাচ্ছি আমাদের দল থেকে। পাহাড় ও সমতলের আদিবাসীরা ৭১-এ বাঙ্গালীর সাথে মিলে মুক্তিযুদ্ধ করেছে। কিন্তু তারা সাংবিধানিক স্বীকৃতি পায়নি। বর্তমানে তাদেরকে সেই স্বীকৃতি দিতে হবে।
শক্তিপদ ত্রিপুরা বলেন, দেশের বিভিন আইনে আদিবাসীদের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, কিন্তু সাংবিধানিকভাবে এখনো সেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। সরকারের বিশেষ একটি মহল আদিবাসীদের নিয়ে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। যদি আদিবাসীদের দাবি মানা না হয় তাহলে দেশের আদিবাসী জনগণ জ্বলে উঠবেন।
সঞ্জীব দ্রং তাঁর স্বাগত বক্তব্যে বলেন, আদিবাসীদের জাতিগত পরিচিতি কি হবে এটা তাদের মানবাধিকার। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুসারে আদিবাসীদের রয়েছে আত্মপরিচয়ের অধিকার। তিনি আদিবাসীদের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের দাবী জানান। তিনি আশা করেন যে, সরকার দেশের ৪৬টির অধিক আদিবাসী জাতিসমূহের প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষের হৃদস্পন্দন অনুভব করবে।
.....................................................................
Courtesy: adivasinews.com
BD Online News For BD News Lover and all time updare bd news.Just chack this link
ReplyDeleteClick for mobile Apps