শান্তির(!) জন্য সংঘাত ও পার্বত্য চট্টগ্রাম
ড. রাহমান নাসির উদ্দিন সংঘাত ও শান্তি বিপ্রতীপ প্রপঞ্চ। তথাপি সংঘাতের ভেতর দিয়ে কখনো কখনো শান্তি আসে। যেমন কোনো কোনো সময় যুদ্ধের ভেতর দিয়ে মুক্তি আসে, যাকে আমরা 'মুক্তিযুদ্ধ' বলি। কিংবা কখনো কখনো সংগ্রামের ভেতর দিয়ে স্বাধীনতা আসে, যাকে আমরা 'স্বাধীনতার সংগ্রাম' বলি। কিন্তু নিজের ঘরের সদস্যদের মধ্যকার আন্ত মারামারি, হানাহানি এবং দ্বন্দ্ব-সংঘাত দিয়ে ঘরে কখনো শান্তি আসে না। বিগত ২১ জানুয়ারি রাঙামাটির জুরাছড়ি উপজেলার ফকিরাছড়া বস্তিপাড়ায় সংঘটিত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) এবং ইউনাইটেড পিপল্স ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) মধ্যকার সংঘাতকে সেই তত্ত্বের ফ্রেমওয়ার্কে বিবেচনা করতে হবে। সংঘাতের পর আদৌ কোনো শান্তি আসে কি না, সে বিষয়ে বিস্তর বাহাস করা গেলেও 'শান্তির জন্য সংঘাত' বিষয়টিকে দেখতে হবে পার্বত্য চট্টগ্রামের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে। তাই যদি পার্বত্য চট্টগ্রামের আপামর পাহাড়িদের শান্তির জন্য পাহাড়িদের মধ্যকার বিবদমান দুটি দলের মধ্যে সংঘাত বাধে এবং ওই সংঘাতের জের ধরে ছয়জন পাহাড়ি নিহত হয়, তাহলে তা কতটা শান্তির জন্য আর কতটা অশান্তির জন্য, তা উপলব্ধিটা জরুরি আপামর পাহাড়িদের অতীত অভিজ্ঞতা, বর্তমান উপলব্ধি এবং ভবিষ্যতের দুর্ভাবনার আলোকে। রাঙামাটিতে সংঘটিত জেএসএস এবং ইউপিডিএফের মধ্যকার এই সংঘাতকে বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণীর প্রায় সব জাতীয় দৈনিক নিউজ আইটেম করেছে, 'শান্তির পক্ষ ও বিপক্ষের মধ্যে সংঘাতে ৬ জন নিহত'। বিবদমান দুই পক্ষের মধ্যে গুলিবিনিময়, রক্তক্ষয়ী সংঘাত এবং ছয়জন পাহাড়ি নিহত হওয়ার মধ্যে 'শান্তি'র আসলে কোনো পক্ষ কিংবা বিপক্ষ থাকতে পারে না।
গত ২১ জানুয়ারি 'রাঙামাটির জুরাছড়ি উপজেলার ফকিরাছড়া বস্তিপাড়ায় জেএসএস এবং ইউপিডিএফের মধ্যে সশস্ত্র সংঘর্ষে ৬ জন পাহাড়ি নিহত হয়েছে' বলে খবরটি রাষ্ট্র হয়েছে। পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, 'চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে ৫ জন লোক নিহত হয়'। সংবাদপত্রের ভাষায়, 'এলাকায় প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে জেএসএস এবং ইউপিডিএফের সশস্ত্র সংঘর্ষে ৬ জন (জেএসএসের ৫ জন এবং ইউপিডিএফের ১ জন) পাহাড়ি নিহত হয়'। জেএসএস দাবি করেছে, 'এটা মৃত্যু নয়, হত্যা। ইউপিডিএফের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা জেএসএসের নিরীহ কর্মীদের হত্যা করেছে।' অন্যদিকে ইউপিডিএফের দাবি, 'পাহাড়িদের ন্যায্য দাবি এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র হিসেবে জেএসএসের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা সুপরিকল্পিতভাবে ইউপিডিএফের কর্মীদের হত্যা করেছে। মূলত জেএসএস আমাদের নির্মূল করতে চায়।' এ ধরনের 'দোষারোপের প্রতিযোগিতা'র মধ্য দিয়ে এই সংঘাতের যে প্রকৃত এবং বিপজ্জনক প্রতিফল, তাকে হালকা করে দেওয়া হচ্ছে। যেটা জানা জরুরি তা হচ্ছে, এ ধরনের সংঘাতের ফলে আসলে লাভবান হচ্ছে কারা। কিংবা জেএসএস এবং ইউপিডিএফের সংঘাত ও হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে পাহাড়িদের নগদ লাভ কিংবা বাকি ক্ষতি কতটুকু, তা জানা অধিকতর জরুরি। পুরো বিষয়টিকে 'পার্বত্য চুক্তি'র বা 'পার্বত্য শান্তিচুক্তি' সম্পাদন এবং তা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামের মধ্যকার অম্ল-মধুর কিংবা তিতা সম্পর্কের কাঠামোতে বিবেচনা করতে হবে। কেননা শান্তিচুক্তি সম্পাদনের সঙ্গে সঙ্গেই কিংবা পরপরই ইউপিডিএফের জন্ম এবং শান্তিচুক্তির নগদ ফল হিসেবেই 'রাষ্ট্রের সঙ্গে পাহাড়িদের' পরিবর্তে 'পাহাড়িদের সঙ্গে পাহাড়িদের' নয়া কিসিমের অশান্তি পয়দা হয়, যা বিগত ১৩ বছর ধরে চলছে; এবং একটি অসমর্থিত সূত্র অনুযায়ী, এ পর্যন্ত প্রায় ২৫০ জন পাহাড়ি নিহত হয়েছে জেএসএস-ইউপিডিএফের সংঘাতের ফলে। আর আহতের তো কোনো হিসাবই নেই!
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত পাহাড়িদের প্রতিনিধি হিসেবে জেএসএস এবং রাষ্ট্রের মধ্যে একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যার মধ্য দিয়ে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিরাজমান সংঘাতময় পরিস্থিতির একটি আপাত সমাধান হয়েছে বলে অনেকে মনে করেছিলেন। চুক্তির আগ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত ১১টি জনগোষ্ঠীর (চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, বম, খেয়াং, খুমি, ম্রো, লুসাই, পাংখোয়া ও চাক) একমাত্র রাজনৈতিক ও প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠন ছিল জেএসএস। কিন্তু শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের বিরোধিতা করে চুক্তির পরপরই ইউপিডিএফের জন্ম, যাদের প্রধান অভিযোগ হচ্ছে, 'চুক্তির মাধ্যমে জেএসএস পার্বত্য চট্টগ্রামের আপামর-পাহাড়িদের স্বাধিকার এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের আন্দোলনকে রাষ্ট্রের কাছে বিক্রি করেছে। এই চুক্তির মাধ্যমে মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ পাহাড়িদের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে রাষ্ট্রের কাছে জলাঞ্জলি দেওয়া হয়েছে।' এই অভিযোগের প্রত্যুত্তরে ইউপিডিএফ তাদের ভাষায় 'পাহাড়ির আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের' জন্য নতুন একটি রাজনৈতিক প্লাটফর্ম হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামে সংগঠিত হতে থাকে। অন্যদিকে জেএসএস ইউপিডিএফকে পাহাড়িদের মধ্যকার একটি সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজ গোষ্ঠীর 'ইমেজ' দিয়ে পাহাড়ে এবং পাহাড়িদের মধ্যে নিজেদের কর্তৃত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব জারি রাখার প্রক্রিয়া হিসেবে একধরনের দমন-পীড়ন নীতি নিয়ে তাদের মোকাবিলা করতে সচেষ্ট হয়। ফলে শুরু হয় সংঘাত_পাহাড়িদের মধ্যকার আন্তসংঘাত। শান্তিচুক্তির পর থেকেই নিয়মিতভাবে জেএসএস এবং ইউপিডিএফের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘাত-সংঘর্ষ চলতে থাকে, যার সর্বশেষ সংযোজন হচ্ছে 'রাঙামাটির জুরাছড়ি'।
উল্লেখ্য, পার্বত্যচুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকাও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। চুক্তি-পরবর্তী সময়ে পার্বত্য চুক্তির বিভিন্ন ধারা-উপধারা যথাযথভাবে বাস্তবায়িত না হওয়া ইউপিডিএফের দাবি এবং বক্তব্যকে অনেকাংশে বৈধতা দেয়। যেমন_চুক্তির প্রধান শর্তগুলো ছিল_১. পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি পাহাড়ি অধ্যুষিত (ঞৎরনধষ ঢ়ড়ঢ়ঁষধঃবফ ৎবমরড়হ) এলাকা হিসেবে গণ্য হবে। ২. শান্তিবাহিনীর সব সদস্যের আত্মসমর্পণ ও অস্ত্রসমর্পণ সাপেক্ষে সাধারণ ক্ষমা করে দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত সব মামলা প্রত্যাহার করে তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সুযোগ করে দেওয়া হবে। ৩. মিয়ানমার এবং ভারতে অবস্থানকারী শরণার্থীদের পর্যায়ক্রমে ফিরিয়ে আনা হবে এবং তাদের নিজেদের আবাসভূমি হিসাবমতো ফেরত দেওয়া হবে। ৪. অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদেরও তাদের নিজ নিজ ভূমি ফিরিয়ে দিয়ে পর্যায়ক্রমে পুনর্বাসিত করা হবে। ৫. প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাসনকালে অভিবাসিত (গরমৎধঃবফ) বাঙালি সেটলারদের পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে পর্যায়ক্রমে অন্যত্র পুনর্বাসন করার ব্যবস্থা করা হবে (যদিও শান্তিচুক্তিতে এ বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট উল্লেখ নেই)। ৬. পার্বত্যাঞ্চল থেকে পর্যায়ক্রমে সব অস্থায়ী মিলিটারি ক্যাম্প অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হবে। ৭. ভূমি কমিশন গঠনের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্যমান ভূমি সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধান করা হবে। ৮. পাহাড়িদের নেতৃস্থানীয় ক্ষমতা দিয়ে একটি কার্যকর পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ এবং তিন পার্বত্য জেলায় নির্বাচনের মাধ্যমে জেলা পরিষদ গঠন ও ক্ষমতায়ন করা হবে ইত্যাদি। কিন্তু অদ্যাবধি এর সিকি ভাগও চুক্তি-উত্তর বিভিন্ন সময় ক্ষমতায় আসা সরকারগুলো পূরণ করেনি। ফলে ইউপিডিএফের বক্তব্যই প্রকারান্তরে সত্য প্রমাণিত হয়েছে; এবং সাধারণ পাহাড়িদের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতার মাত্রা সামান্য হলেও বেড়েছে। অন্যদিকে সম্প্রতি জেএসএসের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতার নেতৃত্বে একটি অংশ নতুন করে জেএসএসের নতুন দল গঠন এবং জেএসএসের অভ্যন্তরীণ সংকটকে উন্মোচিত করে, যা প্রকারান্তরে প্রমাণ করে, পাহাড়িদের অধিকার আদায়ে ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করা সত্ত্বেও জেএসএস এখন আর সব পাহাড়ির একমাত্র প্রতিনিধিত্বশীল রাজনৈতিক ও আঞ্চলিক সংগঠন নয়। এই সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে 'রাঙামাটির জুরাছড়ি'র ঘটনাকে দেখতে হবে।
তবে এটা মনে রাখা জরুরি, জেএসএস এবং ইউপিডিএফের নিজেদের মধ্যকার সংঘাত প্রকারান্তরে শান্তিচুক্তির বাস্তবায়নকে অধিকতর দীর্ঘায়িত করবে। একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। যেমন_সংঘাত যেহেতু সমাজের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ, সেহেতু পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে অস্থায়ী মিলিটারি ক্যাম্পগুলো সরানোর ব্যাপারে সরকার নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নেবে। এভাবে নিজেদের মধ্যকার সংঘাতের মধ্য দিয়ে সত্যিকার অর্থে পাহাড়ে কোনোভাবেই স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। দুটি সংগঠনই যদি সত্যিকার অর্থে পাহাড়িদের বৃহত্তর কল্যাণ চায়, পাহাড়ে সত্যিকার অর্থেই শান্তি আসুক_এটা চায়, পাহাড়ি মানুষের সত্যিকারের প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠন হতে চায়, তাহলে সত্বর সব ধরনের সংঘাতের পথ পরিহার করতে হবে। নিয়মতান্ত্রিক এবং গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারায় পাহাড়িদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধিত্ব করে, এ রকম বিষয় নিয়ে রাষ্ট্রের সঙ্গে দরকষাকষি করে পাহাড় ও পাহাড়িদের বৃহত্তর কল্যাণের জন্য কাজ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, ঐতিহাসিকভাবে বঞ্চিত, রাষ্ট্র কর্তৃক অমানবিকভাবে নির্যাতিত, উন্নয়নে অবহেলিত, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী হিসেবে আম-পাহাড়িদের ভাগ্যোন্নয়নের রাজনৈতিক কর্মকৌশল কখনোই কোনো পারস্পরিক সংঘাত হতে পারে না। তাই 'রাঙামাটির জুরাছড়ি'র সংঘাত প্রকৃত অর্থে 'শান্তির জন্য সংঘাত নয়', এটা 'অশান্তির সংঘাত'। জেএসএস এবং ইউপিডিএফ যত দ্রুত এটা উপলব্ধি করতে পারবে, তত দ্রুতই পাহাড় এবং পাহাড়িদের লাভ। পাহাড়ে সত্যিকারের শান্তি আসার সম্ভাবনা উজ্জ্বলতর হবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষক
-----------
courtesy: Kaler Kantho (27.01.2011)
ড. রাহমান নাসির উদ্দিন সংঘাত ও শান্তি বিপ্রতীপ প্রপঞ্চ। তথাপি সংঘাতের ভেতর দিয়ে কখনো কখনো শান্তি আসে। যেমন কোনো কোনো সময় যুদ্ধের ভেতর দিয়ে মুক্তি আসে, যাকে আমরা 'মুক্তিযুদ্ধ' বলি। কিংবা কখনো কখনো সংগ্রামের ভেতর দিয়ে স্বাধীনতা আসে, যাকে আমরা 'স্বাধীনতার সংগ্রাম' বলি। কিন্তু নিজের ঘরের সদস্যদের মধ্যকার আন্ত মারামারি, হানাহানি এবং দ্বন্দ্ব-সংঘাত দিয়ে ঘরে কখনো শান্তি আসে না। বিগত ২১ জানুয়ারি রাঙামাটির জুরাছড়ি উপজেলার ফকিরাছড়া বস্তিপাড়ায় সংঘটিত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) এবং ইউনাইটেড পিপল্স ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) মধ্যকার সংঘাতকে সেই তত্ত্বের ফ্রেমওয়ার্কে বিবেচনা করতে হবে। সংঘাতের পর আদৌ কোনো শান্তি আসে কি না, সে বিষয়ে বিস্তর বাহাস করা গেলেও 'শান্তির জন্য সংঘাত' বিষয়টিকে দেখতে হবে পার্বত্য চট্টগ্রামের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে। তাই যদি পার্বত্য চট্টগ্রামের আপামর পাহাড়িদের শান্তির জন্য পাহাড়িদের মধ্যকার বিবদমান দুটি দলের মধ্যে সংঘাত বাধে এবং ওই সংঘাতের জের ধরে ছয়জন পাহাড়ি নিহত হয়, তাহলে তা কতটা শান্তির জন্য আর কতটা অশান্তির জন্য, তা উপলব্ধিটা জরুরি আপামর পাহাড়িদের অতীত অভিজ্ঞতা, বর্তমান উপলব্ধি এবং ভবিষ্যতের দুর্ভাবনার আলোকে। রাঙামাটিতে সংঘটিত জেএসএস এবং ইউপিডিএফের মধ্যকার এই সংঘাতকে বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণীর প্রায় সব জাতীয় দৈনিক নিউজ আইটেম করেছে, 'শান্তির পক্ষ ও বিপক্ষের মধ্যে সংঘাতে ৬ জন নিহত'। বিবদমান দুই পক্ষের মধ্যে গুলিবিনিময়, রক্তক্ষয়ী সংঘাত এবং ছয়জন পাহাড়ি নিহত হওয়ার মধ্যে 'শান্তি'র আসলে কোনো পক্ষ কিংবা বিপক্ষ থাকতে পারে না।গত ২১ জানুয়ারি 'রাঙামাটির জুরাছড়ি উপজেলার ফকিরাছড়া বস্তিপাড়ায় জেএসএস এবং ইউপিডিএফের মধ্যে সশস্ত্র সংঘর্ষে ৬ জন পাহাড়ি নিহত হয়েছে' বলে খবরটি রাষ্ট্র হয়েছে। পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, 'চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে ৫ জন লোক নিহত হয়'। সংবাদপত্রের ভাষায়, 'এলাকায় প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে জেএসএস এবং ইউপিডিএফের সশস্ত্র সংঘর্ষে ৬ জন (জেএসএসের ৫ জন এবং ইউপিডিএফের ১ জন) পাহাড়ি নিহত হয়'। জেএসএস দাবি করেছে, 'এটা মৃত্যু নয়, হত্যা। ইউপিডিএফের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা জেএসএসের নিরীহ কর্মীদের হত্যা করেছে।' অন্যদিকে ইউপিডিএফের দাবি, 'পাহাড়িদের ন্যায্য দাবি এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র হিসেবে জেএসএসের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা সুপরিকল্পিতভাবে ইউপিডিএফের কর্মীদের হত্যা করেছে। মূলত জেএসএস আমাদের নির্মূল করতে চায়।' এ ধরনের 'দোষারোপের প্রতিযোগিতা'র মধ্য দিয়ে এই সংঘাতের যে প্রকৃত এবং বিপজ্জনক প্রতিফল, তাকে হালকা করে দেওয়া হচ্ছে। যেটা জানা জরুরি তা হচ্ছে, এ ধরনের সংঘাতের ফলে আসলে লাভবান হচ্ছে কারা। কিংবা জেএসএস এবং ইউপিডিএফের সংঘাত ও হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে পাহাড়িদের নগদ লাভ কিংবা বাকি ক্ষতি কতটুকু, তা জানা অধিকতর জরুরি। পুরো বিষয়টিকে 'পার্বত্য চুক্তি'র বা 'পার্বত্য শান্তিচুক্তি' সম্পাদন এবং তা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামের মধ্যকার অম্ল-মধুর কিংবা তিতা সম্পর্কের কাঠামোতে বিবেচনা করতে হবে। কেননা শান্তিচুক্তি সম্পাদনের সঙ্গে সঙ্গেই কিংবা পরপরই ইউপিডিএফের জন্ম এবং শান্তিচুক্তির নগদ ফল হিসেবেই 'রাষ্ট্রের সঙ্গে পাহাড়িদের' পরিবর্তে 'পাহাড়িদের সঙ্গে পাহাড়িদের' নয়া কিসিমের অশান্তি পয়দা হয়, যা বিগত ১৩ বছর ধরে চলছে; এবং একটি অসমর্থিত সূত্র অনুযায়ী, এ পর্যন্ত প্রায় ২৫০ জন পাহাড়ি নিহত হয়েছে জেএসএস-ইউপিডিএফের সংঘাতের ফলে। আর আহতের তো কোনো হিসাবই নেই!
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত পাহাড়িদের প্রতিনিধি হিসেবে জেএসএস এবং রাষ্ট্রের মধ্যে একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যার মধ্য দিয়ে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিরাজমান সংঘাতময় পরিস্থিতির একটি আপাত সমাধান হয়েছে বলে অনেকে মনে করেছিলেন। চুক্তির আগ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত ১১টি জনগোষ্ঠীর (চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, বম, খেয়াং, খুমি, ম্রো, লুসাই, পাংখোয়া ও চাক) একমাত্র রাজনৈতিক ও প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠন ছিল জেএসএস। কিন্তু শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের বিরোধিতা করে চুক্তির পরপরই ইউপিডিএফের জন্ম, যাদের প্রধান অভিযোগ হচ্ছে, 'চুক্তির মাধ্যমে জেএসএস পার্বত্য চট্টগ্রামের আপামর-পাহাড়িদের স্বাধিকার এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের আন্দোলনকে রাষ্ট্রের কাছে বিক্রি করেছে। এই চুক্তির মাধ্যমে মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ পাহাড়িদের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে রাষ্ট্রের কাছে জলাঞ্জলি দেওয়া হয়েছে।' এই অভিযোগের প্রত্যুত্তরে ইউপিডিএফ তাদের ভাষায় 'পাহাড়ির আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের' জন্য নতুন একটি রাজনৈতিক প্লাটফর্ম হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামে সংগঠিত হতে থাকে। অন্যদিকে জেএসএস ইউপিডিএফকে পাহাড়িদের মধ্যকার একটি সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজ গোষ্ঠীর 'ইমেজ' দিয়ে পাহাড়ে এবং পাহাড়িদের মধ্যে নিজেদের কর্তৃত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব জারি রাখার প্রক্রিয়া হিসেবে একধরনের দমন-পীড়ন নীতি নিয়ে তাদের মোকাবিলা করতে সচেষ্ট হয়। ফলে শুরু হয় সংঘাত_পাহাড়িদের মধ্যকার আন্তসংঘাত। শান্তিচুক্তির পর থেকেই নিয়মিতভাবে জেএসএস এবং ইউপিডিএফের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘাত-সংঘর্ষ চলতে থাকে, যার সর্বশেষ সংযোজন হচ্ছে 'রাঙামাটির জুরাছড়ি'।
উল্লেখ্য, পার্বত্যচুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকাও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। চুক্তি-পরবর্তী সময়ে পার্বত্য চুক্তির বিভিন্ন ধারা-উপধারা যথাযথভাবে বাস্তবায়িত না হওয়া ইউপিডিএফের দাবি এবং বক্তব্যকে অনেকাংশে বৈধতা দেয়। যেমন_চুক্তির প্রধান শর্তগুলো ছিল_১. পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি পাহাড়ি অধ্যুষিত (ঞৎরনধষ ঢ়ড়ঢ়ঁষধঃবফ ৎবমরড়হ) এলাকা হিসেবে গণ্য হবে। ২. শান্তিবাহিনীর সব সদস্যের আত্মসমর্পণ ও অস্ত্রসমর্পণ সাপেক্ষে সাধারণ ক্ষমা করে দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত সব মামলা প্রত্যাহার করে তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সুযোগ করে দেওয়া হবে। ৩. মিয়ানমার এবং ভারতে অবস্থানকারী শরণার্থীদের পর্যায়ক্রমে ফিরিয়ে আনা হবে এবং তাদের নিজেদের আবাসভূমি হিসাবমতো ফেরত দেওয়া হবে। ৪. অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদেরও তাদের নিজ নিজ ভূমি ফিরিয়ে দিয়ে পর্যায়ক্রমে পুনর্বাসিত করা হবে। ৫. প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাসনকালে অভিবাসিত (গরমৎধঃবফ) বাঙালি সেটলারদের পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে পর্যায়ক্রমে অন্যত্র পুনর্বাসন করার ব্যবস্থা করা হবে (যদিও শান্তিচুক্তিতে এ বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট উল্লেখ নেই)। ৬. পার্বত্যাঞ্চল থেকে পর্যায়ক্রমে সব অস্থায়ী মিলিটারি ক্যাম্প অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হবে। ৭. ভূমি কমিশন গঠনের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্যমান ভূমি সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধান করা হবে। ৮. পাহাড়িদের নেতৃস্থানীয় ক্ষমতা দিয়ে একটি কার্যকর পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ এবং তিন পার্বত্য জেলায় নির্বাচনের মাধ্যমে জেলা পরিষদ গঠন ও ক্ষমতায়ন করা হবে ইত্যাদি। কিন্তু অদ্যাবধি এর সিকি ভাগও চুক্তি-উত্তর বিভিন্ন সময় ক্ষমতায় আসা সরকারগুলো পূরণ করেনি। ফলে ইউপিডিএফের বক্তব্যই প্রকারান্তরে সত্য প্রমাণিত হয়েছে; এবং সাধারণ পাহাড়িদের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতার মাত্রা সামান্য হলেও বেড়েছে। অন্যদিকে সম্প্রতি জেএসএসের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতার নেতৃত্বে একটি অংশ নতুন করে জেএসএসের নতুন দল গঠন এবং জেএসএসের অভ্যন্তরীণ সংকটকে উন্মোচিত করে, যা প্রকারান্তরে প্রমাণ করে, পাহাড়িদের অধিকার আদায়ে ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করা সত্ত্বেও জেএসএস এখন আর সব পাহাড়ির একমাত্র প্রতিনিধিত্বশীল রাজনৈতিক ও আঞ্চলিক সংগঠন নয়। এই সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে 'রাঙামাটির জুরাছড়ি'র ঘটনাকে দেখতে হবে।
তবে এটা মনে রাখা জরুরি, জেএসএস এবং ইউপিডিএফের নিজেদের মধ্যকার সংঘাত প্রকারান্তরে শান্তিচুক্তির বাস্তবায়নকে অধিকতর দীর্ঘায়িত করবে। একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। যেমন_সংঘাত যেহেতু সমাজের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ, সেহেতু পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে অস্থায়ী মিলিটারি ক্যাম্পগুলো সরানোর ব্যাপারে সরকার নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নেবে। এভাবে নিজেদের মধ্যকার সংঘাতের মধ্য দিয়ে সত্যিকার অর্থে পাহাড়ে কোনোভাবেই স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। দুটি সংগঠনই যদি সত্যিকার অর্থে পাহাড়িদের বৃহত্তর কল্যাণ চায়, পাহাড়ে সত্যিকার অর্থেই শান্তি আসুক_এটা চায়, পাহাড়ি মানুষের সত্যিকারের প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠন হতে চায়, তাহলে সত্বর সব ধরনের সংঘাতের পথ পরিহার করতে হবে। নিয়মতান্ত্রিক এবং গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারায় পাহাড়িদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধিত্ব করে, এ রকম বিষয় নিয়ে রাষ্ট্রের সঙ্গে দরকষাকষি করে পাহাড় ও পাহাড়িদের বৃহত্তর কল্যাণের জন্য কাজ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, ঐতিহাসিকভাবে বঞ্চিত, রাষ্ট্র কর্তৃক অমানবিকভাবে নির্যাতিত, উন্নয়নে অবহেলিত, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী হিসেবে আম-পাহাড়িদের ভাগ্যোন্নয়নের রাজনৈতিক কর্মকৌশল কখনোই কোনো পারস্পরিক সংঘাত হতে পারে না। তাই 'রাঙামাটির জুরাছড়ি'র সংঘাত প্রকৃত অর্থে 'শান্তির জন্য সংঘাত নয়', এটা 'অশান্তির সংঘাত'। জেএসএস এবং ইউপিডিএফ যত দ্রুত এটা উপলব্ধি করতে পারবে, তত দ্রুতই পাহাড় এবং পাহাড়িদের লাভ। পাহাড়ে সত্যিকারের শান্তি আসার সম্ভাবনা উজ্জ্বলতর হবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষক
-----------
courtesy: Kaler Kantho (27.01.2011)

No comments:
Post a Comment